ক্ষমতা দখলের জন্য সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষী ও পাকিস্তান ফেরত এবং জাসদ সমর্থিত কিছু অফিসারদের পারস্পরিক হানাহানি এবং নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডকে বিপ্লব বলা চরম মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা ওই সময়ের কিছু গোপন দলিল ও নথিপত্রের দেখা যায় যে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ‘৭ই নভেম্বররের সিপাহী বিদ্রোহ’কে মূলত সিপাদীদের রুটি-রুজির প্রশ্নে অসন্তোষের ফল হিসাবে মূল্যায়ন করেছেন।
মার্কিন দূতাবাসের উপপ্রধান ছিলেন আরভিং জি. চেসল। তিনিও বিষয়টি সেভাবেই দেখেছেন। আর ৭ নভেম্বরকে সংহতি দিবস বলারও কোনো কারণ নেই, এদিন কার সাথে কার সংহতি হয়েছিল? জনগণের সাথে সিপাহীদের? ১৫ আগষ্টের পর হতে সেনাবাহিনীতে যা হচ্ছিল জনসাধারণের পক্ষে জানা সম্ভবই ছিল না; জনগণ ছিল নীরব দর্শক। আর সিপাহীদের মধ্যেও কোনোপ্রকার সংহতি হ্য় নি, বরং এটা ছিল সিপাহীদের মধ্যে একটা অংশের বিদ্রোহ। ৭ নভেম্বরের পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকায় নিযুক্ত তত্কালীন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার লিখেছেন, ‘ঢাকা সেনানিবাসে শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে গোলাগুলি শুরু হয়। ক্ষুদ্র অস্ত্র (স্মল আর্মস) ও মর্টারের গোলাবর্ষণ চলে। সেনারা রেডিও স্টেশনের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যায়। একটি সংবাদপত্রের দপ্তরেও একটি ছোট সেনাদল দেখা গেছে। দূতাবাসের কাছেও গোলাবর্ষণের আওয়াজ মিলছে। আমরা মনে করি যে, সেনাবাহিনীর প্রতিদ্বন্দ্বী উপদলগুলো প্রকাশ্য সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এয়ারপোর্ট রোডে বসবাসরত একজন বাঙালি সহকারী একটি ট্রাকবোঝাই সেনাদের স্লোগান শুনেছেন। তাঁরা স্লোগান দিচ্ছেন: জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ।’ সিপাহীদের মধ্যে যে সংহতি হয় নি তার প্রমাণ জেনারেল জিয়াউর রহমান তার পাচ বছরের শাসনামলে প্রায় ২১টি অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ২১টি অভ্যুত্থান থেকে বেঁচে গেলেও ২২তম অভ্যুত্থানে তিনি শোচনীয়ভাবে মৃত্যুবরন করেন।
৭ই নভেম্বরের ঘটনা ‘বিদ্রোহ’ ছিল; কোনোমতেই ‘বিপ্লব’ নয়।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ১১ এবং ১২ই নভেম্বর দুটি বেতার ভাষণ দেন। এতে তিনি ৭ নভেম্বরের ঘটনাকে সিপাহি-জনতার বিপ্লব বলে দাবি করেননি। বরং তিনি ওই দিন সেনাবাহিনীতে ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টির জন্য জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে (জাসদ) দায়ী করেছিলেন।
জিয়া এ ভাষনে আরও বলেন, “তিনি একজন সৈনিক, রাজনীতিক নন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, সামরিক আইন তুলে নিতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ’। তাঁর ভাষায়, এ সরকার ‘সম্পূর্ণরূপে নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক। সেদিন তিনি ওয়াদা করেছিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি নির্বাচন দিয়ে দ্রুত ব্যারাকে ফিরে যাবেন। ২৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রদত্ত আরেকটি ভাষনেও তিনি একই কথা বলেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, তিনি তাঁর কথা রাখেননি।
বরং তিনি তার রক্ষাকর্তা কর্নেল তাহেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলান। বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক এর কারণ হিসাবে তাহেরের জনপ্রিয়তাকেই কারণ বলে মনে করেন। সৈনিকদের মধ্যে তাহের জনপ্রিয়তা ভবিষ্যতে জিয়ার কর্তৃত্বে আঘাত হানতে পারে বলেই তাকে পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে তাদের অভিমত।
“৭ নভেম্বর ১৯৭৫ -আলো থেকে অন্ধকারে পতিত হওয়ার কাহিনী” শীর্ষক কলামে কলামিস্ট সৈয়দ বদরুল আহ্সান লিখছেন, “…স্মরণ করুন ৭ নভেম্বরের ভয়াবহ দৃশ্যগুলো। বিভিন্ন সেনানিবাসে দেশপ্রেমিক সৈনিক ও অফিসারদের হত্যা করার পর্ব চলছে। কোনো দলিল নেই এবং কোনো প্রমাণ নেই যে কর্নেল তাহের এবং জেনারেল জিয়া চেষ্টা করেছেন খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সহযোগীদের প্রাণে বাঁচাতে। রাজধানী ঢাকার সড়কে সেই পাকিস্তানি কায়দায় স্লোগান শোনা গেল পুরো উদ্যমে। যে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শোনা গিয়েছিল ১৫ আগস্টের ভোরবেলায়, সেই ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ই আরও জোরালোভাবে আমাদের শোনানো হলো ৭ নভেম্বরে। গোটা বাংলাদেশটাকে মনে হলো একটি ছোট পাকিস্তান। আবার এও বলা যায় যে সেদিন আমাদের কাছে মনে হয়েছিল, দেশটি একটি বানানা রিপাবলিকে পরিণত হয়েছে। যে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আমরা পাকিস্তানে সংগ্রাম করেছি এবং সংগ্রামে জয়ী হয়েছি, সেই সামরিক শাসন আবার স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের জীবনের ধারাটাকে একেবারে ইতিহাসবিরোধী একটি স্রোতে পরিণত করে দিল। ……৭ নভেম্বর এর কারণেই এ দেশে ইতিহাস বিকৃতির সূচনা হয় এবং এই দিনটি সুযোগ করে দেয় সেই পুরোনো পাকিস্তানি দোসরদের, যাতে করে তারা বাংলাদেশে সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারে।
এসব কথা শেষ হওয়ার নয়। আমাদের আঁধার এখনো কাটেনি। যে আলোর ভুবন আমরা তৈরি করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের দ্বারা, সেই ভুবনটি আঁধারে ছেয়ে গেছে ওই দিন, যেদিন খালেদ মোশাররফকে প্রাণ দিতে হলো এই স্বাধীন দেশে।”
একাত্তরের পরাজিত চক্রের সগর্ব প্রত্যাবর্তন এবং পুনর্বাসন ছাড়া এই বিপ্লবের আর কোন ফল অন্তত দৃষ্টত চোখে ধরা পড়ে না। পঁচাত্তরের নভেম্বারের অফিসার হত্যাকে যদি বিপ্লব বলে গ্লরিফাই করা হয়, তাহলে মাঝে মাঝে এমন বিপ্লব করার মানসিকতা স্থায়ীভাবে দূর হবে কী করে? কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া পিলখানা ঘটনার দিনও ‘সিপাহি জনতা ভাই ভাই’- শ্লোগান উঠেছিল। প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে এটারও কারণ ছিল রুটি-রূজির প্রশ্নে অসন্তোষ। যদি এ বিদ্রোহীরা সফল হতো এবং হাসিনা সরকারের পতন হয়ে পচাত্তরের মতো আরেকটি নুতন সরকার আসতো, তাহলে কি আমাদের জাতীয় জীবনে আরেকটি বিপ্লব-দিবস যোগ হতো!