বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসা-ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য প্রতিনিধি সম্মেলন আহবানকে কেন্দ্র করে সংগঠনটিতে আবার অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখা দিয়েছে।
সংগঠনটির প্রয়াত আমীর আহমদ শফীর অনুসারীরা এই সম্মেলনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলেছেন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থেকে হেফাজতে ইসলামকে ভাঙনের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
তবে তাদের বিরোধীরা আগামী রোববার চট্টগ্রামে হাটহাজারী মাদ্রাসায় এই প্রতিনিধি সম্মলনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার কথা বলেছেন। তারা দাবি করেন, কিছু লোক ছিটকে পড়তে পারে। কিন্তু প্রতিনিধি সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের সংগঠনের নেতাকর্মীরা আরও ঐক্যবদ্ধ হবে।
তবে এখন একটি অংশ প্রতিনিধি সম্মেলনের আয়োজন করেছে রোববার চট্টগ্রামে হাটহাজারী মাদ্রাসায়। সেই সম্মেলনে নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য সারাদেশ থেকে ৫০০ প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে এর আয়োজকরা জানিয়েছেন।
কিন্তু আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানী সংগঠনটির এখনকার কমিটির প্রচার সম্পাদক। তিনি এবং কমিটির নায়েবে আমীরসহ বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের অনুসারী যারা রয়েছেন, তাদের কাউকেই সম্মেলনে ডাকা হয়নি। এই পটভূমিতে সংগঠনটিতে বিভক্তি স্পষ্ট হয়েছে।
আহমদ শফীর অনুসারী হিসাবে পরিচিত এবং হেফাজতে ইসলামের নেতা মঈনউদ্দিন রুহী বলছেন, কোন কমিটিতে আলোচনা ছাড়া ব্যক্তির রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে অবৈধভাবে এই সম্মেলন করা হচ্ছে বলে তারা মনে করেন।
“যেদিন হেফাজত গঠন হয়েছে, সেদিন থেকেই আমি এর যুগ্ম মহাসচিব। হেফাজতের কাউন্সিল করার জন্য এপর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোন আালোচনা বা কোন মিটিং কখনও করা হয় নি। এটা একজন ব্যক্তির আমীর হওয়ার জন্য এবং রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ হাসিল করার জন্য এই কাউন্সিল করা হচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ অবৈধ।”
রুহী আরও বলছেন, “এতে আল্লামা শফীর অনুসারী এবং মুফতি ফজলুল হক আমিনীর অনুসারীদের দাওয়াত দেয়া হয় নাই। এবং চিহ্নিত রাজনৈতিক দল যাদের সাথে হেফাজতের মিল ছিল না। এখন কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাদের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।”
তিনি উল্লেখ করেন, “আমরা মনে করি, হেফাজতকে খণ্ডিত, বিভক্ত বা ভাগ করবার জন্য এটা একটা দুরভিসন্ধি পরিকল্পনা।” রুহীর বক্তব্যে এও এসেছে যে, আহমদ শফীর অনুসারীরা এখন ঐ প্রতিনিধি সম্মেলনের বিরুদ্ধে তাদের করণীয় ঠিক করার জন্য নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালাচ্ছেন।
এদিকে, সম্মেলনের আয়োজকরা জানিয়েছেন, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী সম্মেলন পরিচালনা করবেন। আর বাবুনগরীর আত্নীয় মহিবুল্লাহ বাবুনগরী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবেন এবং তিনিই এই সম্মেলনের অন্যতম আয়োজক। তাকে নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন আহমদ শফীর অনুসারীরা।
তারা বলেছেন, মহিবুল্লাহ বাবুনগরী হেফাজতে ইসলাম থেকে অনেক আগে পদত্যাগ করেছেন এবং তিনি কোন সম্মেলন আহবান করতে পারেন না।
তবে শফীর অনুসারীদের বিরোধী অংশের নেতা এবং হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেছেন, তারা বৈধভাবেই সম্মেলন ডেকে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। এখানে কিছু লোকের বিরোধিতার কারণে তাদের সংগঠনে ভাঙনের কোন বিষয় নেই বলে তারা মনে করেন।
“যারা অভিযোগ করে, তারা আসলে হেফাজতের এই উত্থান সম্পর্কে জনগণকে বা আমাদের কর্মীদের বিভ্রান্ত করে সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য চেষ্টা করছে।”
আজিজুল হক ইসলামাবাদী শফীর অনুসারীদের সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দেয়ার বিষয়েও সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “এখন কেউ যদি কমিটিতে থেকে হেফাজতের বিরুদ্ধে পত্রপত্রিকায় বিবৃতি দেয়, তাহলে তো সঙ্গতকারণে তাদের এড়িয়ে চলবে। সম্প্রতিকালেতো অনেকে বিবৃতি দিয়েছেন যে, হেফাজতকে ছিনতাই করা হচ্ছে, হাইজ্যাক করা হচ্ছে, এ সমস্ত অভিযোগ যদি কেউ করে তাহলেতো অবশ্যই সে বাদ পড়বে।”
ইসলামাবাদী আরও বলেন, “এটা বিভক্তি নয়। এটা হচ্ছে বিভক্তি করার চক্রান্ত। যাদের ব্যাপারে হেফাজতের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ, তাদেরকে তো হেফাজতের কমিটিতে রাখার সুযোগ নাই।” তিনি প্রশ্ন রাখেন, “অনভিপ্রেত বা অনাকাঙ্খিত কোন ঘটনা ঘটলে-এগুলো সামাল দেবে কে?”
ব্লগারদের বিরুদ্ধে ঢাকার মতিঝিলে শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে হেফাজতে ইসলাম আলোড়ন তুলেছিল ২০১৩ সালে। এরপর সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আমীর আহমদ শফীর সাথে সরকারের সখ্যতা গড়ে ওঠে।। গত কয়েক বছর ধরে সরকারের সাথে সখ্যতার প্রশ্নে সংগঠনটিতে পক্ষে-বিপক্ষে দু’টি ধারার সৃষ্টি হয়েছিল।
কারণ সরকার-বিরোধী বিভিন্ন ইসলামপন্থী দলের নেতারাও সংগঠনটিতে রয়েছেন। এখন সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে বিভক্তি দৃশ্যমান হয়েছে। দুই পক্ষের নেতাদের বক্তব্যেও তা উঠে এসেছে। হেফাজতে ইসলামের সাথে ঘনিষ্ট এবং লেখক শরীফ মোহাম্মদ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন ভিন্নভাবে।
তিনি বলছেন, “শুরুর দিক থেকে যারা ছিলেন, তাদের একটা অংশের অনেকের ব্যাপারে হযরত আহমদ শফী হুজুরের জীবদ্দশায় বড় একটা অংশের পক্ষ থেকে কিছু কিছু বিষয়ে আপত্তি বা অভিযোগ ছিল। এই জায়গাগুলো দৃশ্যমান হলে দেখতে খারাপ লাগবে। তবে আমার কাছে বড় কোন ভাঙন এখনও মনে হচ্ছে না।”
এদিকে আহমদ শফীর অনুসারীরা বলেছেন, এখন যে অংশ প্রতিনিধি সম্মেলন ডেকেছে, সেই সম্মেলনে ঐ অংশ জুনায়েত বাবুনগরীকেই আমীর করতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন। কিন্তু সম্মেলন আহবানকারীরা বলেছেন, সম্মেলনে নেতা ঠিক করবেন অংশগ্রহণকারীরা।
সূত্র-বিবিসি বাংলা