ডেস্ক নিউজ
আলেম ওলামাদের মধ্যে মুখরোচক শব্দ হলো, জামায়াত ঢুকে পড়েছে। খাওয়ার সঙ্গে যেমন কাঁচামরিচ খায়, আচার খায়, এটা মুখরোচক; ক্ষুধা মেটানোর জন্য না। জামায়াত ঢুকে পড়েছে, এটাও এমন শব্দ। তবে এটা আন্দোলন সংগ্রামের ভাষা হতে পারে না- হেফাজতের নায়েবে আমির আবদুর রব ইউসূফী।
ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নতুন যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তার নেতাদের বড় অংশই বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক দলের নেতা।
যেসব নেতা বিএনপি জামায়াত জোট ছেড়ে গেছেন, বা জামায়াতের কট্টর সমালোচক, নতুন কমিটিতে তাদের বাদ দেয়া হয়েছে।
২০০৭ সালের বাতিল হওয়া নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গঠন করা খেলাফতে মজলিসের একাংশের কয়েকজন নেতা স্থান পেয়েছেন এই কমিটিতে। তবে ওই জোট ভেঙে তারা আগেই বিএনপি জোটে ফিরে গেছেন।
এদের একজন মাওলানা তাফাজ্জল হক আজিজ। তিনি ২০০৭ সালে সুনামগঞ্জের একটি আসনে নৌকা প্রতীকে ভোটে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরে ছয় দফা চুক্তি বাতিলের পর আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থানে ফিরে যান।
রোববারের জাতীয় সম্মেলনের আগের দিন প্রয়াত আমির শাহ আহমেদ শফীর অনুসারীরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, হেফাজতকে বিএনপি-জামায়াত জোটের দখলে নেয়ার চেষ্টা চলছে।
হেফাজতের নতুন কমিটিতে বিএনপি-জামায়াত জোট সংশ্লিষ্টদের স্থান পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনের নায়েবে আমির আবদুর রব ইউসুফী বিষয়টি অস্বীকার করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ধর্মীয় বিষয় আর রাজনৈতিক বিষয়কে মেলানো যায় না। পার্থক্য আছে। যেমন আওয়ামী লীগকে ইসলামবিরোধী বললেও তার সঙ্গে রাজনৈতিক স্বার্থে জোট হতে পারে।’
ইউসুফী নিজেও বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতা। তিনি বলেন, ‘আলেম ওলামাদের মধ্যে মুখরোচক শব্দ হলো, জামায়াত ঢুকে পড়েছে। খাওয়ার সঙ্গে যেমন কাঁচামরিচ খায়, আচার খায়, এটা মুখরোচক; ক্ষুধা মেটানোর জন্য না। জামায়াত ঢুকে পড়েছে, এটাও এমন শব্দ। তবে এটা আন্দোলন সংগ্রামের ভাষা হতে পারে না।’
ইউসুফীর দাবি, কাউকে দায়িত্ব দলীয়ভাবে দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘যেহেতু এটা আলেম ওলামাদের সংগঠন, বিভিন্ন জেলায় সামাজিকভাবে যারা এগিয়ে তাদেরকেই পদ দেয়া হয়েছে।’
হেফাজতের নতুন তথ্য ও প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়েজী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০ দলীয় জোটে নেই, এমন অনেককেও কমিটিতে নেয়া হয়েছে। লালবাগ মাদ্রাসার যোবায়ের সাহেবকে সহকারী মহাসচিব করা হয়েছে। এ রকম আরও কয়েকজন আছেন।’
তাহলে ২০ দলীয় জোট ছেড়ে যাওয়া নেতারা কেন বাদ পড়লেন- এমন প্রশ্নে হেফাজত নেতা বলেন, ‘যাদের নিয়ে সাংগঠনিক বিতর্ক আছে, তাদেরকে বাদ দেয়া হয়েছে। এখানে অন্য কিছু নেই।’
সম্মেলনের পর ঘোষিত কমিটির মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমী ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব।
১৫১ সদস্যের যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাতে কাসেমীর জমিয়তেরই ৩২ জনের মতো নেতা আছেন।
বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক খেলাফতে মজলিসের একাংশ থেকে নেয়া হয়েছে আরও ছয় জনকে। এদের একজন এককালে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতি ছিলেন।
জামায়াতবিরোধী বা ২০ দল ছেড়ে আসারা বাদ
যাদেরকে বাদ দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন জামায়াতের কট্টর সমালোচক চরমোনাইয়ের পীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম। তিনি আগের কমিটির নায়েবে আমির ছিলেন।
চরমোনাইয়ের পীরের রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন হেফাজত নির্ভেজাল অরাজনৈতিক সংগঠন ছিল। তাই চরমোনাই পীর তাতে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। পরে অনেক নেতা হেফাজতকে রাজনীতিতে টেনে আনেন। যেসব ইসলামিক রাজনৈতিক দলের গণভিত্তি নেই, জনসমর্থন নেই, তারা টিকে থাকতে এখন হেফাজতকে আঁকড়ে ধরছেন। একটি দলেরই কেন্দ্রীয় কমিটির ২০/২৫ জন নেতা হেফাজতের কমিটিতে এসেছেন। এটা তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের বহিঃপ্রকাশ।’
হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী বলেন, ‘চরমোনাইয়ের পীর সাহেব গত চার পাঁচ বছর ধরে হেফাজতের কর্মসূচিতে ছিলেন না। তিনি নিজের মতো করে কর্মসূচি পালন করেন। তাই তাকে রাখা হয়নি।’
বিবেচনায় নেয়া হয়নি কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব ও কওমি সদনের স্বীকৃতি আদায়ে কাজ করা ফরিদউদ্দিন মাসউদকে।
গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার মাওলানা রুহুল আমিন দুটি কওমি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান। তাকেও কোনো পদে রাখা হয়নি, যদিও বাকি চারটি বোর্ডের চেয়ারম্যানদের রাখা হয়েছে।
রুহুল আমিন আওয়ামী ঘনিষ্ঠ আলেম হিসেবে পরিচিত। তিনিও কওমি সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
বাদ পড়েছেন বিএনপি-জামায়াত জোট থেকে বের হয়ে যাওয়া ইসলামী ঐক্যজোটর মহাসচিব মুফতি মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ। তিনি আগের কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন।
তবে ২০ দল ছাড়ার পর ইসলামী ঐক্যজোট থেকে বের হয়ে অন্য দলে যোগ দেয়া জুনায়েদ আল হাবিবকে ঠিকই কমিটিতে রাখা হয়েছে।
এসব বিষয়ে হেফাজতের নায়েবে আমির আবদুর রব ইউসুফী বলেন, ‘ওনারা বিতর্কিত হয়ে পড়েছিলেন গত আন্দোলন থেকেই।’
কোন আন্দোলন?
ইউসুফী বলেন, ‘শাপলা চত্বরের আন্দোলনের সময় তারা তাদের কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত হয়ে পড়েছিলেন।’
ইউসুফী বলছিলেন লালবাগ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক আলেমদের কথা, যারা ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতের অবস্থান নিয়ে ভূমিকা রাখেন। তবে ২০১৬ সালের শুরুতে তারা বিএনপি-জামায়াত জোট থেকে বের হয়ে আসেন।
তারা কেন বিতর্কিত, সেটা অবশ্য বলতে চাননি ইউসুফী। বলেন, ‘ওই সময় মিডিয়াতে এসেছে। আমি যদি বিতর্কিত হয়ে যাই আমারই দায়িত্ব ব্যাখ্যা দেয়া। কিন্তু তারা তা দেননি। তাদের কিছু ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে জনগণ ও মাদ্রাসার মধ্যে।’
এতদিনে কেন এসব কথা বলছেন- এমন প্রশ্নে ইউসুফী বলেন, ‘কথা বলিনি ঠিক আছে, তবে মিডিয়ায় অনেক কিছু এসেছে।’
বাদ পড়েছেন আগের কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী, প্রচার সম্পাদক প্রয়াত আমির আল্লামা শফীর ছেলে আনাস মাদানী, সিনিয়র নায়েমে আমির মাওলানা সলিমুল্লাহ।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ১০ বছরের আমির শাহ আহমেদ শফীর মৃত্যুর আগে থেকেই হেফাজতে নানা বিষয়ে বিরোধ ছিল।
শফীর পরে সংগঠন কাদের নিয়ন্ত্রণে যাবে এ নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ ছিল। কওমি মাদ্রাসার সনদ দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্সের সমমান দেয়ার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত শোকরানা সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি করার আয়োজনের বিরোধী ছিলেন বাবুনগরী। পরে হেফাজতে তাকে কোণঠাসা করা হয়। যদিও আল্লামা শফীর মৃত্যুর দুই দিন আগে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় যে হাঙ্গামা হয়, তখন শফীর ছেলে আনাস মাদানী ও তার অনুসারীদের মাদ্রাসা ও হেফাজত থেকে বের করে দেয়া হয়। এমনকি বাবার জানাজাতেও যেতে পারেননি আনাস।
ওই ঘটনার পর বাবুনগরী হেফাজতে অবস্থান শক্ত করেন। ফিরে আসেন হাটহাজারী মাদ্রাসায়।
শফীর মৃত্যুর দুই মাস পর হেফাজতের নতুন কমিটি ঘোষণার জন্য যে সম্মেলন ডাকা হয়, তার বিরোধিতা করে একটি অংশ। ৫০ জনের মতো নেতাকে বাদ দিয়েই পরে করা হয় সম্মেলন।
যাদেরকে বাদ দেয়া হয়েছে, তারা নতুন কমিটি ঘোষণা করতে যাচ্ছেন বলে প্রচার আছে। এমনকি নতুন কমিটিতে উপদেষ্টা করা সাবেক সংসদ সদস্য মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাসও অভিযোগ করেছেন, হেফাজত গঠতন্ত্র লঙ্ঘন করে এই কমিটি করেছে। এটা তিনি মানেন না।
হেফাজত নেতা মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যাই বলেন, এবারের কমিটি ব্যাপক হয়েছে, সুবিন্যস্ত হয়েছে।’
বিএনপি-জামায়াতের শরিক জমিয়তের যেসব নেতা
সংগঠনের উপদেষ্টামণ্ডলীতে জায়গা পেয়েছেন মাওলানা জিয়াউদ্দীন, মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক।
নায়েবে আমির পদে জমিয়তের ছয় জন নেতা জায়গা পেয়েছেন। এরা হলেন: মাওলানা আব্দুল হামিদ (মধুপুর) মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ সাদী, মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া, মাওলানা আনোয়ারুল করিম (যশোর) ও মাওলানা নুরুল ইসলাম খান (সুনামগঞ্জ)।
নতুন চার যুগ্ম মহাসচিবের দুজন জমিয়তের। এরা হলেন, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব ও মাওলানা নাসির উদ্দিন মুনির।
সহকারী মহাসচিব হয়েছেন মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী ও মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি।
সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছেন মাওলানা মাসউদুল করীম টঙ্গী, মাওলানা শামসুল ইসলাম জিলানী ও মাওলানা তাফহিমুল হক।
অর্থ সম্পাদক হয়েছেন মুফতি মুনির হোসাইন কাসেমী ও সহকারী অর্থ সম্পাদক মাওলানা লোকমান মাজহারী।
সহকারী প্রচার সম্পাদক হয়েছেন জমিয়তের তিন নেতা। তারা হলেন−মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব ওসমানী, মুফতি শরীফুল্লাহ ও মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান।
আইন বিষয়ক সম্পাদক হয়েছেন মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরী। তিনি বিএনপি-জামায়াত জোটের হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে সংসদ নির্বাচন করেছেন।
দাওয়াহ সম্পাদক হয়েছেন মাওলানা নাজমুল হাসান, সহকারী আন্তর্জাতিক সম্পাদক হয়েছেন মাওলানা শুয়াইব আহমদ, মাওলানা গোলাম কিবরিয়া, সহকারী দফতর সম্পাদক হয়েছেন মাওলানা সিদ্দিকুল ইসলাম তোফায়েল।
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছেন জামিল আহমদ চৌধুরী, বশির আহমদ, তাফাজ্জল হক আজিজ, আলী আকবর সাভার, আবু আব্দুর রহিম, আব্দুল কুদ্দুস মানিকনগর, মুহাম্মদ উল্লাহ জামি, মাওলানা হাবিবুল্লাহ মাহমুদ কাসেমী।
খেলাফতে মজলিসের দুই অংশের যারা
বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক খেলাফত মজলিসের ছয়জন নেতা স্থান পেয়েছেন। এদের মধ্যে উপদেষ্টামণ্ডলীতে আছেন দলের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক। নায়েবে আমির হয়েছেন আহমাদ আবদুল কাদের, যিনি ছাত্র জীবনে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতি ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নায়েবে আমির আবদুর রব ইউসুফী বলেন, ‘আহমদ আবদুল কাদেরকে নিয়ে তো সমমনা ইসলামী দল করা হয়েছে। তিনি খেলাফতে মজলিসে নায়েবে আমির ছিলেন। ইসলামী ঐক্যজোটেও ছিলেন। তখনও তার আগের শিবির-সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেনি। এখন কেন উঠবে?’
এই দলের মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন হয়েছেন নায়েবে আমির।
সহকারী আন্তর্জাতিক সম্পাদক হয়েছেন মাওলানা আবদুল কাদের সালেহ ও আহমদ আলী কাসেমী।
২০ দলীয় জোটের শরিক খেলাফত মজলিসের আরেক অংশের আমির মাওলানা ইসমাঈল নূরপুরী হয়েছেন উপদেষ্টা। নায়েবে আমির হয়েছেন সাবেক মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হয়েছেন মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক।
মাওলানা খোরশেদ আলম কাসেমী ও মাওলানা জালালুদ্দিন হয়েছেন সহকারী মহাসচিব। যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন হয়েছেন সহকারী সাংগঠনিক সম্পাদক। মওলানা ফয়সাল আহমদ হয়েছেন সহ প্রচার সম্পাদক।
দলটির বেশ কয়েকজন ভক্ত ও অনুসারী আলেম জায়গা পেয়েছেন হেফাজতের বিভিন্ন পদে।