হাইকোর্টের জাস্টিসিয়া ভাস্কর্য অপসারণের দাবি ওঠার পর আমরা অনেকেই বলেছিলাম যে তাদের দাবি এখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় এবার সফল হলে পরবর্তীতে সকল ভাস্কর্য ও কবর ভাঙার দাবি তোলা হবে। বাংলাদেশ যে আফগানিস্তানের দিকে যাচ্ছে তা সকলে টের পান কিনা ঠিক জানি না!
আফগানিস্তানের অনুকরণে সম্প্রতি বাংলাদেশেও ভাস্কর্য ভাঙার দাবি তুলেছে কওমি বা দেওবন্দি হিসেবে পরিচিতদের একটি অংশ। তারা সকল ভাস্কর্যের বিরোধী নাকি শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেই তাদের আপত্তি তা অবশ্য তারা সুস্পষ্টভাবে বলেননি।
মাসিক আল কাউসার ও জামায়াতে ইসলামীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত দুটি লেখাকে ভিত্তি করে মাওলানা মামুনুল হক সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ফতোয়া’ প্রকাশ করেছেন। ‘খোদ বাংলা ভাষার গ্রহণযোগ্য প্রতিটি ডিকশনারি’ এর সূত্র দিয়ে তিনি আরবি ভাষাকেন্দ্রিক ইস্যুতে ‘ফতোয়া’ দিয়েছেন।
তার লেখায় ‘ভাস্কর্য ও মূর্তি এক ও অভিন্ন’ উল্লেখের পাশাপাশি পাকা কবর ও ক্যান্টনমেন্টে স্থাপিত শিখা অনির্বাণকেও ইসলাম বিরোধী বলা হয়েছে। মূর্তি হলে কি ভাঙতে হবে?
হাইকোর্টের জাস্টিসিয়া ভাস্কর্য অপসারণের দাবি ওঠার পর আমরা অনেকেই বলেছিলাম যে তাদের দাবি এখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় এবার সফল হলে পরবর্তীতে সকল ভাস্কর্য ও কবর ভাঙার দাবি তোলা হবে। বাংলাদেশ যে আফগানিস্তানের দিকে যাচ্ছে তা সকলে টের পান কিনা ঠিক জানি না!
ভাস্কর্য ও শিল্পকর্মের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১. সাহাবীদের সময়কাল থেকে কোনো ভূখণ্ডে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর ভাস্কর্য বা মূর্তি ভাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি। গুটিকয়েক বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া পরবর্তীতেও এ ধারা অব্যাহত ছিল।
২. ১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে বিশ্বের ১৮ জন আইন প্রণেতার ভাস্কর্য স্থাপন করা হয় যার একটি ছিল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর। সে ভাস্কর্যের এক হাতে ছিল কোরআন, অন্য হাতে তরবারি। আজহারিসহ অনেক মাওলানা সাহেব গর্বের সঙ্গে এটি উল্লেখ করেন।
৩. ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত নিউ ইয়র্কের কোর্টে রাসুল (সাঃ) এর ভাস্কর্য ছিল। পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও মিশরের রাষ্ট্রদূত ভাস্কর্যের মুখমণ্ডল সমান করে দেয়ার দাবি করে আপত্তি তুলেছিল।
৪. তৈমুর লংয়ের ছেলে শাহরুখ মির্জার শাসনামলে লিখিত ‘মেরাজ নামা’য় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ছবি আঁকা হয়েছিল, যা লাইব্রেরি অব ফ্রান্সে সংরক্ষিত আছে।
৫. ইরানে কাজার ডাইনাস্টির শাসনামলে পঞ্চ পাঞ্জতনের কাহিনী প্রকাশিত হয়েছিল চিত্রকর্মের মাধ্যমে।
৬. তুরস্কের ব্রিজম্যান আর্ট গ্যালারিতে ওসমানিয়া খেলাফতের সময়কার পেইন্টিং আছে যেখানে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ছবি আঁকা হয়েছে।
৭. পাকিস্তানে জিন্নাহর ভাস্কর্য রয়েছে বহু স্থানে। লাহোরে বেনজীর ভুট্টো ও লাজপত রায়ের ভাস্কর্য রয়েছে। ইরান, ইরাক, মরক্কো ও তুরস্কে শতাধিক ভাস্কর্য রয়েছে। মানুষের ভাস্কর্য আছে কুয়েত, কাতার ও দুবাইয়েও। সম্ভবত আফগানিস্তান ছাড়া সকল মুসলিম দেশেই ভাস্কর্য রয়েছে।
৮. সৌদি আরবে কি ভাস্কর্য নেই? সৌদি আরবে উটের ভাস্কর্য রয়েছে, সৌদি আরবের জেদ্দা মিউজিয়ামে ভাস্কর্য রয়েছে। সেখানে আয়োজিত মেলায় স্ট্যাচু অব লিবার্টির রেপ্লিকা ও শয়তানের ভাস্কর্যের প্রদর্শনী হয়েছিল।
যে উদাহরণগুলো দিয়েছি তাতে মহানবী (সাঃ) এর ভাস্কর্য ইসলাম-সম্মত কিনা তা নিয়ে তেমন কোনো আপত্তি ওঠেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্যে ‘অন্যতম শ্রেষ্ঠ আইন প্রণেতা’ উল্লেখ করে আল্লাহর আইনকে মানুষের আইন বলা হয়েছে। এতে সম্মান দেয়া হয়েছে নাকি বিতর্ক তোলা হয়েছে তা বোঝার মতো বোধও অনেকের নেই।
ফতোয়ার সেকাল-একাল
১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে রাসুল (সাঃ) এর ভাস্কর্যে তরবারি থাকা নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। অনেকে ভাস্কর্যের মুখমণ্ডল সমান করে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালে সৌদি আরবের ফিকাহ শাস্ত্রের অধ্যাপক তাহা জাবের আল আলওয়ানি এই মর্মে ফতোয়া দেন যে, ‘ভাস্কর্যটি প্রশংসনীয় ও শিক্ষামূলক। এর মাধ্যমে সঠিক বার্তা দেয়া হয়েছে, যা অনেক ভ্রান্তি নিরসনে সক্ষম হবে।’ ইরানের আয়াতুল্লাহ সিসতানীর ফতোয়া মোতাবেক রাসুল (সাঃ) এর ভাস্কর্য বা চিত্রায়ন তাজিমের সঙ্গে উপস্থাপন করা হলে তা জায়েজ।
ইসলাম এমন কোনো ধর্ম নয় যার বিধান সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল। তাই একশ বছর আগে যা হারাম ছিল তাকে যদি এখন হালাল হিসেবে গণ্য করা হয়, তাহলে বুঝতে হবে সীমাবদ্ধতা মোল্লাদের চিন্তা চেতনায়। এক সময় মাইকে আজান দেয়াকে বিদআত হিসেবে গণ্য করতেন অনেক আলেম। এ উপমহাদেশেই ইংরেজি শিক্ষাকে নাজায়েজ ফতোয়া দেয়া হয়েছিল।
আজ থেকে দুই যুগ আগেও বিশ্বের প্রায় সকল আলেমের অভিমত ছিল ছবি, ক্যামেরা, টিভি, ভিডিও ইত্যাদি হারাম। দেওবন্দ এখনো এই সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। তাদের মতে মদ হাতে বানালেও হারাম, মেশিনে বানালেও হারাম, তাই পেইন্টিং ও ডিজিটাল ছবি উভয়ই হারাম। দেওবন্দের ফতোয়া অস্বীকার করে মামুনুল হকরা নিজেদের দেওবন্দি দাবি করেন কীভাবে? আকাবীরদের অনুসরণের কথা বলে তাদের ফতোয়া অমান্য করেন কীভাবে?
এখানে একচেটিয়াভাবে ছবি ও ভাস্কর্যকে হারাম বলা যেমন ইসলাম-সম্মত নয় তেমনি রাসুল (সাঃ) এর ভাস্কর্যের পক্ষে দেয়া ফতোয়াও গ্রহণযোগ্য নয়।
ইসলাম যা বলে:
হারাম বা নাজায়েজ বিষয়গুলো নির্দিষ্ট করা। সাধারণ নিয়মে যা কিছু হারাম সেগুলো ছাড়া সবই হালাল বা মুবাহ। মুস্তাদরাক হাকিম, তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ এ বর্ণিত সহি হাদিস অনুসারে হারাম বা হালালের মধ্যবর্তী বিষয়গুলোকে আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে অনুমতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া উপেক্ষা করতে বলা হয়েছে, যদি তা ইবাদত সংশ্লিষ্ট অস্পষ্ট বিষয় হয়।
আল্লাহ বলেন, অতঃপর তোমরা তার কিছু হালাল ও কিছু হারাম করেছ, বলুন, ‘আল্লাহ কি তোমাদেরকে এটার অনুমতি দিয়েছেন, নাকি তোমরা আল্লাহর উপর মিথ্যা রটনা করছ? (সুরা ইউনুস: ৫৯)
ইসলামে ইবাদত ও হারাম/হালাল নির্ধারণের এখতিয়ার শুধুমাত্র আল্লাহর। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের ইচ্ছানুসারে হারাম-হালাল নির্ধারণকে ক্ষমার অযোগ্য শিরকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। (সুরা আন’আম ১৪০)
ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাস্কর্য
কোরআনের কোথাও ছবি আঁকা বা ভাস্কর্য তৈরিকে নিষিদ্ধ বলা হয়নি। মূর্তি বা যেসব জড়বস্তুকে উপাসনা করা হয় তাকে আরবিতে বলা হয় ওয়াসান বা সানাম (বহুবচনে আওসান বা আসনাম)। এর সমার্থক শব্দ হচ্ছে মাবুদ, আল মাবুদ, সুরা, তাগুয়া ইত্যাদি। অন্যদিকে ভাস্কর্যকে বলা হয় তামাসিল/তিমসাল/তামসাল যার ইংরেজি হচ্ছে মেমোরিয়াল, মনুমেন্ট বা স্ট্যাচু। মূর্তি ও ভাস্কর্যের পার্থক্য উপাসনার কারণে। অন্যদিকে হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে তাসবীরকে।
কোরআনে সুরা সাবার ১৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
‘তারা সোলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী উপাসনালয় ও দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউযসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত।….”
ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে যে বিধিনিষেধ ছিল না তার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত রয়েছে। আবু বকর (রাঃ) এর শাসনামলে আমর বিন আসের মিশর অভিযানে ফারাও ও স্ফিংস ভাস্কর্য অক্ষত ছিল। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের ইরাকে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সময়ও কোনো মূর্তি ভাঙ্গা হয়নি।
জাদুঘরে ভাস্কর্য অনুমোদনে ফতোয়া
ভাস্কর্য নিয়ে আপত্তি তোলার সূচনা হয় মূলত ১১ শতাব্দী থেকে ইবনে খুদামা ও ইবনে তাইমিয়ার সূত্র ধরে। বর্তমানে সৌদি আরব (জেদ্দা) সহ প্রায় সকল মুসলিম দেশেই ভাস্কর্য বা ভাস্কর্যের মিউজিয়াম রয়েছে।
এক্ষেত্রে প্রদত্ত ফতোয়ায় বলা হয়, সুরা আন’আম এর ১১ ও সুরা আলে ইমরানের ১৩৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বিশ্ব ভ্রমণ করে দেখতে ও শিখতে বলেছেন। তাই ভাস্কর্য দেখে ইতিহাস সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করা যাবে। এছাড়া মিশরের স্ফিংস ও ফেরাউনের মমিকে কোরআনে বর্ণিত আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়ছে।
আগের শরীয়তে কি ভাস্কর্য জায়েজ ছিল?
অনেকের মতো মামুনুল হকও কোরআনে ভাস্কর্য সংশ্লিষ্ট আয়াতের প্রেক্ষাপটে বলেছেন, আগের শরীয়তের অনেক কিছু রদ করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- তিনি আগের শরীয়ত কোথায় পেয়েছেন? কোরআনে বা হাদিসে কি একে আগের শরীয়তের বিধান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে? সোলায়মান (আ:) সংশ্লিষ্ট আয়াত কোথায় রদ করা হয়েছে? এর সূত্র তিনি দিতে পারবেন না।
আগের শরীয়ত বলতে যদি বাইবেল বোঝানো হয় তাহলে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাইবেলের ওল্ড এবং নিউ টেস্টামেন্টেও উপাসনার জন্য মূর্তি তৈরি করা নিষেধ রয়েছে। সুরা মায়েদার ১১০ নম্বর আয়াতে ঈশা (আঃ) কর্তৃক মাটি দিয়ে পাখি সদৃশ তৈরি করে আল্লাহর হুকুমে জীবিত করার কথা উল্লেখ রয়েছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, কেউ কেউ দাবি করেছেন এই আয়াতে নাকি মূর্তি তৈরি নিষিদ্ধ হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। একজন নবী হারাম কাজ করবেন তা কীভাবে কেউ চিন্তা করতে পারে জানি না! বিভিন্ন বিষয়ে এ জাতীয় হাস্যকর ফতোয়ার তালিকা করলে মহাগ্রন্থ হবে।
তর্কের খাতিরে শরীয়তের বিধান রদের কথা মেনে নিলে মানে দাঁড়ায় এই যে, মুসা (আঃ) ও ইব্রাহিম (আঃ) এর সময়ে ভাস্কর্য নিষিদ্ধ ছিল, সোলায়মান (আঃ) ও ঈশা (আঃ) এর সময়ে আবার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আসলেই যদি এমন হতো তাহলে সুস্পষ্টভাবেই নির্দেশ দেয়া হতো, যা মদ, জুয়া, সুদ ইত্যাদি বিষয়ে দেয়া হয়েছে।
হাদিসে নিষিদ্ধ তাসবীর প্রসঙ্গ
হাদিসে যে বিষয়টি নিষেধ করা হয়েছে তা হচ্ছে তাসবীর। একে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করতে হলে ছবি, ক্যামেরা, ভিডিও সবকিছুকেই হারাম হিসেবে গণ্য করতে হবে। তবে বাংলা বা উর্দু/হিন্দির তাসবীর অর্থ ও আরবির অর্থ এক নয়।
আরবি ব্যাকরণ অনুসারে তাসবীর হচ্ছে ক্রিয়া (বাবে তাফয়িলের মাসদার) অর্থাৎ তাসবীর বলতে ছবি বা চিত্রকর্ম তৈরি করাকে বোঝায় যা উপাসনা করার জন্য তৈরি করা হয়। উপাসনাকে বিবেচনা করেই তাসবীর নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলেই ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সাঃ) কর্তৃক তাসবীর নিষিদ্ধের কথা উল্লেখ করার পর গাছপালা ও প্রকৃতির ছবি আঁকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
উপাসনার কারণে নিষিদ্ধ ছিল বলেই মাথা ছাড়া ছবি বা প্রাণহীন কিছুর ছবি/চিত্র/শিল্পকর্ম জায়েজ এই মর্মে হাদিস পাওয়া যায়।
ইসলামের বিধিবিধানের ক্ষেত্রে কোরআন ও সুন্নাহর নির্দিষ্ট নির্দেশনার প্রেক্ষাপট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিচ্ছিন্ন আয়াত বা হাদিস উল্লেখ করে কেউ ইসলামের বিরোধিতা করে, কেউ ধর্ম ব্যবসা করে। ইসলামের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে তাওহীদ এবং আল্লাহর ইবাদত।
প্রি-ইসলামিক আরবে মূর্তি পূজার প্রচলন ছিল। তখন ঘোড়া, সিংহ, ঈগল ইত্যাদি পশুপাখীর মূর্তিকে দেবতা হিসেবে গণ্য করা হতো। মুহাম্মদ (সাঃ) একত্ববাদের প্রতি ঈমান সুদৃঢ় করার জন্য জীবজন্তুর ছবি আঁকা, মূর্তি তৈরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কঠোরভাবে নিষেধ করেন যেন কেউ পূজার পথে ফিরে না যায়। যেমন: ইসলামের প্রথম যুগে কবর জেয়ারতও নিষিদ্ধ ছিল।
রাসুল (সাঃ) যখন অনুধাবন করলেন যে কবরকে উপাসনালয়ে পরিণত করা হবে না, তখন তিনি কবর জেয়ারতের অনুমতি দেন। অনুরূপভাবে কাবায় থাকা মূর্তিগুলোকে ভাঙার আদেশ দেয়া হলেও চূড়ান্তভাবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় ও দেব-দেবীর মূর্তির ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করার অনুমোদন দেয়া হয়নি।
তাসবীর নিষিদ্ধ করার যে হাদিসগুলো রয়েছে তার সময়কাল বিবেচনা করলে রাসুল (সাঃ) এর ইন্তেকালের দুই বছর আগের হাদিসটি উল্লেখযোগ্য: (আবু দাউদে বর্ণিত ৪১ নং কিতাবের হাদিস নং ৪৯১৪ (কিতাবুল আদাব: ৬২)।
রাসুল (সাঃ) তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে হযরত আয়েশার (রাঃ) হাতে কিছু পুতুল দেখেন। পুতুলগুলোর একটি ছিল ঘোড়া, যার ডানা কাপড় দিয়া বানানো হয়েছে। রাসুল (সাঃ) জিজ্ঞাসা করেন, ‘ডানাওয়ালা ঘোড়া?’
উত্তরে আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আপনি কি শোনেননি যে সোলায়মানের ডানাওয়ালা ঘোড়া ছিল?’
এ প্রসঙ্গে আয়েশা বলেন, ‘এতে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এমন অট্টহাসি হাসলেন যে আমি ওনার মাড়ির দাঁত দেখতে পেলাম।’
হালাল ও হারামের নির্ধারক যখন ইলাহ
মূর্তি নিষিদ্ধের কারণ বিবেচনা করলে দেখা যায় ইলাহ বা উপাস্য হিসেবে গ্রহণের বিষয়টি জড়িত। ভাস্কর্য নিষিদ্ধ নয় এমন অভিমতের ভিত্তিও ইলাহ-এর অনুপুস্থিতি। উদাহরণ স্বরূপ: আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করতে হয় না। এটিকে আক্ষরিক অর্থে ধরে নিলে বলতে হবে, শরীরচর্চা বা কোনো কারণে মাথা নিচু করাও নিষেধ। এমন কেউ বলবে না। কারণ ইবাদত একটি আমল যার প্রাথমিক ভিত্তি নিয়ত।
একইভাবে বলা যায়, কবুতর হালাল কিন্তু এই কবুতরকে যদি আমি মাবুদ বা ইলাহ হিসেবে গণ্য করি তখন তা হারাম এবং শিরক বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ জীবিত কিছুও হারামের আওতায় আসতে পারে। কিন্তু তাই বলে কবুতর হারাম হয়ে যাবে না। কবুতরের পরিবর্তে কার্যকারণটিকে হারাম হিসেবে বিবেচনা করা হবে। মূর্তি ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে ঠিক এটিই ঘটছে। আর এ কার্যকারণের কারণেই হজরে আসওয়াদ নিয়ে আপত্তি ওঠেনি।
ইসলামী ব্যক্তিত্বদের অভিমত
কোনো মুফতির পক্ষেই এক পাক্ষিকভাবে ভাস্কর্য বা ছবির বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ্য অবস্থান নেয়া সম্ভব নয়। যেমন: ছবি বা ভিডিওর ক্ষেত্রে বৈধতার যে যুক্তি দেয়া হয় তা বিবেচনা করলে মৃত মানুষের ছবি বা ভিডিও নাজায়েজ হওয়ার কথা। আবার পূর্বের ফকিহদের অভিমত যদি ধ্রুব হিসেবে ধরে নিতে হয় তাহলে কোরআন এন্ড মডার্ন সায়েন্স নিয়ে আলোচনা ও যুক্তি মূল্যহীন হওয়ার কথা। ইসলাম একটি শাশ্বত ধর্ম, যার বিধিবিধান একদিকে সুনির্দিষ্ট, অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
প্রখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ আবদুহু তার প্রদত্ত ফতোয়ায় বলেছেন, ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরতে চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্যের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আল আজহারের গ্র্যান্ড শায়েখ জাদুল হক, প্রখ্যাত আলেম মুহাম্মদ ইমারাহ, ইউরোপিয়ান ফতোয়া কাউন্সিলের শেখ ফয়সালসহ অনেক ইসলামী ব্যক্তিত্ব ভাস্কর্য ও ছবি অনুমোদনের পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন। ছবি, মূর্তি ও ভাস্কর্য ইস্যুতে যে বিষয়েই সকলে একমত তা হচ্ছে, উপাসনার উদ্দেশ্যে কিছু আঁকা বা ভাস্কর্য তৈরি করা যাবে না।
এখন যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন তারা আসলে ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করছেন। কারণ যে হাদিসে উপাসনার জন্য ছবি নিষেধ বলা হয়, সেখানে কুকুর ও রিবাকেও হারাম করা হয়েছে। মদ, মিথ্যাচার, ঘুষ এগুলোও হারাম এবং কবিরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। নাজায়েজবাদীরা সেসব নিয়ে নীরব কেন?
প্রকৃতপক্ষে কথিত ইসলামী নেতাদের আদর্শ ও অনুপ্রেরণা হচ্ছে তালেবান, আইএস ও আল কায়েদা। তারা আগেও বাংলাকে আফগান বানানোর স্বপ্ন দেখেছে। তালেবানি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতির বদলে ইসলামের অনুশাসন যদি তাদের পাথেয় হতো, তাহলে ‘নাস্তিকদের জ্যান্ত কবর দেয়া হবে’, ‘ভাস্কর্য বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করা হবে’, ‘চোখ তুলে নেয়া হবে’ – এ জাতীয় উগ্রবাদী বক্তব্য দেয়ার কথা নয়।
খারেজি মতাদর্শের না হলে তাদের জানার কথা হেদায়েত আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত, যেখানে জোর-জবরদস্তি চলে না। পেশিশক্তির হুমকি দিয়ে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য কারা করছে- তা কি বলার অপেক্ষা রাখে? ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই জানার কথা, প্রত্যেককে শুধু নিজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে, অন্যের কর্ম সম্পর্কে নয় এবং একজন ইসলাম প্রচারকের কাজ সুন্দর ভাষায় বার্তা পৌঁছে দেয়া, পেশিশক্তি দেখানো নয়।
কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, আর যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা জমিনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না, তারা বলে, ‘আমরা তো কেবল সংশোধনকারী।’