জনশক্তি রপ্তানিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকায় থাকা দালালরা বৈধতা পেতে চলেছে। প্রতারণা কমানোর অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চলেছে সরকার। এর ফলে কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির কোনো দালালের মাধ্যমে প্রবাসে গিয়ে শ্রমিক প্রতারিত হলে তা নির্ধারণ করা সহজ হবে। বর্তমানে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ এই দালালদের মাধ্যমেই মূলত বিদেশে যায়। পরে প্রতারিত হলে আর রিক্রুটিং এজেন্সির নাম-পরিচয় বলতে পারে না। আবার নাম-পরিচয় বললেও এজেন্সিগুলো দালালদের দায় স্বীকার করে না। এ পরিস্থিতির অবসানের জন্যই দালালদের নিবন্ধনের আওতায় আনার এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দালাল নিবন্ধনের এ প্রক্রিয়া নির্ধারণের জন্য জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক ও বেসরকারি এজেন্সিগুলোর মালিকদের সংগঠন বায়রার প্রতিনিধিসহ একটি কমিটি করা হয়েছে। জানা যায়, দেশের জনশক্তি রপ্তানির কোনো আইনেই দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগী বলে কিছু নেই। অথচ গ্রামগঞ্জ ও শহরে ছড়িয়ে আছে ৫০ হাজার থেকে লাখখানেক দালাল। তারাই বছরের পর বছর ধরে জনশক্তি রপ্তানির নিয়ন্ত্রক। জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশে লোক পাঠাতে সরাসরি এই দালালদের ওপরই নির্ভর করে। তাই প্রতারণা কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। এই ‘দালাল’ বা ‘উপ-দালাল’ প্রতিপালন করে থাকে মূলত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোই। বেশির ভাগ রিক্রুটিং এজেন্সি পুরোটাই দালালনির্ভর। মূলত তাদের নিয়োগকৃত দালালরাই বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে কর্মী সংগ্রহ করেন। দালালরা সংগৃহীত প্রতি কর্মী বাবদ এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট কমিশন যেমন পেয়ে থাকেন, তেমনি আবার নানা প্রলোভন দেখিয়ে তারা গোপনে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে থাকেন। বেশির ভাগ দালালই অভিবাসী হতে ইচ্ছুক কর্মীদের কাছে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করেন। বেশি বেতন আর সুযোগ-সুবিধার কথা বলে তারা অভিবাসী হতে ইচ্ছুকদের আয়ত্তে নেন। এরপর পাসপোর্ট তৈরি, মেডিকেল টেস্ট, সত্যায়ন, ভিসা ক্রয়- এরকম নানান খাত দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে নেন। দালালদের খপ্পরে সবচেয়ে বেশি পড়ে লেখাপড়া না জানা অদক্ষ কর্মীরা।
বাংলাদেশের অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রামরুর পক্ষ থেকে প্রায় দেড় যুগ ধরে দালালদের নিবন্ধনের আওতায় নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। রামরুর সমন্বয়ক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, বিদেশগামী এবং রিক্রুটিং এজেন্সি দুই পক্ষই এখন দালালদের ওপর নির্ভরশীল। একজন কর্মী বিদেশে যেতে চাইলে কোথায় যাবেন, কী করবেন সে ব্যাপারে যথেষ্ট সরকারি তথ্য নেই। এই সুযোগ নেয় দালালরা। আবার রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর তৃণমূলে কোনো কার্যক্রম নেই। তাদের সবার অফিস ঢাকায়। ফলে তাদেরও বিদেশে পাঠানোর জন্য লোক আনতে এই দালালদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এভাবেই দালাল প্রথা টিকে আছে বছরের পর বছর। তার মতে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার খরচ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর অন্যতম কারণ এই দালাল প্রথা। যত হাত ঘোরে, অভিবাসন খরচ তত বাড়ে। বিএমইটি মহাপরিচালক শামসুল আলম বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে অভিবাসন আইন অনুযায়ী। প্রতিনিধি বা দালাল যাই বলা হোক না কেন তারা একসঙ্গে দুটি এজেন্সিতে কাজ করতে পারবে না। কোনো অপরাধ করলে তাদের যেন আটক করার সুযোগ থাকে।
জানা যায়, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে বিদেশে যান ৫ লাখের বেশি বাংলাদেশি। আরও লক্ষাধিক কর্মী টাকা দিয়েও বিদেশে যেতে পারেন না। পাশাপাশি এক-তৃতীয়াংশ কর্মী বিদেশে গিয়ে বিভিন্নভাবে প্রতারিত হয়ে থাকে। এসব প্রতারিতের বেশির ভাগের জন্যই এজেন্সিগুলোকে শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয় না। কারণ বেশির ভাগ কাজই হয় দালালদের মাধ্যমে। আর বাংলাদেশের অভিবাসন প্রত্যাশীদের বড় অংশ আসলে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর চেয়ে দালালদের ওপরই বেশি আস্থা রাখেন।