দেশের ১৬ কোটির মধ্যে পাঁচ কোটি মানুষের ভ্যাকসিন নিশ্চিত করেছে সরকার। বাজারে আসার আগেই প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভ্যাকসিন নিশ্চিত হওয়াকে আশাব্যঞ্জক হিসেবে দেখা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া ভ্যাকসিন বিনামূল্যে পাবেন দেশের নাগরিকরা। বাকি ভ্যাকসিনের মূল্য কি হবে তা পরে নির্ধারণ করা হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ এখন ভ্যাকসিন প্রয়োগের জন্য টার্গেট গ্রুপ নির্ধারণ করার পাশাপাশি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছর প্রথমার্ধেই মহামারীর বিরুদ্ধে কার্যকর এই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হওয়া সম্ভব। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, আরও দেখে জেনে বুঝে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন, ভ্যাকসিন কেনার জন্য ইতোমধ্যে ৭৩৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে ছাড় করেছে অর্থ বিভাগ। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনে বিনামূল্যে তা মানুষকে দেয়া হবে।
ইতোপূর্বের ঘোষণা অনুযায়ী দ্য গ্লোবাল এ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস এ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস গ্যাভি ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ করোনা ভ্যাকসিন দেবে। এর বাইরে সরকার আরও তিন কোটি ডোজ করোনা ভ্যাকসিন কেনার জন্য চুক্তি করেছে। এছাড়া বেসরকারী উদ্যোগে ১০ লাখ ডোজ আমদানির অনুমোদন চেয়েছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড। সব মিলিয়ে ৯ কোটি ৯০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন নিশ্চিত হয়েছে। প্রত্যেকের জন্য দুই ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োজন হলে এর মধ্যে ৪ কোটি ৯৪ লাখ মানুষের ভ্যাকসিন নিশ্চিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার ভ্যাকসিন প্রয়োগের একটি অংশ বেসরকারী খাতে ছাড়তে চাইলে আরও দ্রুত এই কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান বলেন, আমরা অক্সফোর্ডের এ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটি নিয়েই কাজ করছি। এটি আমাদের জন্য ভাল হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে যেখানেই আমাদের উপযোগী ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে সেখান থেকেই আমরা ভ্যাকসিন কিনব। এ খাতে সরকার পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রেখেছে। আশার খবর হচ্ছে এখন পর্যন্ত পাঁচটি ভ্যাকসিন তৃতীয়ধাপের ট্রায়াল শেষ করেছে। অন্তর্বর্তী ফলাফল প্রকাশ করেছে চারটি ভ্যাকসিনের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। আর একটি কোম্পানি এখনও ফলাফল জানায়নি। এর বাইরেও দুটি ভ্যাকসিন আশার আলো দেখাচ্ছে। এই দুটি ভ্যাকসিনই যুক্তরাষ্ট্রের। জনসন এ্যান্ড জনসন এবং নোভাভ্যাক্স ভ্যাকসিন দুটির আবিষ্কারক। আগামী বছরের প্রথমার্ধে ভ্যাকসিন দুটির তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শেষ হবে। এসব কোম্পানির ভ্যাকসিনের দাম তুলনামূলকভাবে কম হবে। একই সঙ্গে সংরক্ষণ তাপমাত্রাও বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী হবে। ফলে এখনই এদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দ্রুত ভ্যাকসিন পাওয়া যেতে পারে। জনসন এ্যান্ড জনসন বলছে তারা এক বিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে। জানুয়ারিতেই তৃতীয়ধাপের ফল হাতে আসতে পারে। জনসন এ্যান্ড জনসন বলছে অন্য ভ্যাকসিনগুলো দুই ডোজ প্রয়োজন হলেও তাদেরটি এক ডোজ নিলেই চলবে। আর এটির দাম হবে প্রতি ডোজ ১০ ডলারের মধ্যে। তবে এটি চূড়ান্ত নয়। অন্যদিকে এপ্রিলের দিকে নোভাভ্যাক্স তাদের ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশ করবে। প্রতিযোগিতায় একটু পিছিয়ে পড়ায় তুলনামূলক কম দামে এবং সহজে তাদের কাছ থেকে ভ্যাকসিন পাওয়া যেতে পারে।
ভ্যাকসিন পেতে এখন সারা বিশ্বই তীব্র প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বিশ্বের ধনী দেশগুলো একজন নাগরিকের বিপরীতে পাঁচটি ভ্যাকসিন আগাম কিনে রেখেছে। সেখানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্য অনেক দেশই এখন ভ্যাকসিনের সংস্থান করতে পারেনি। তবে বৈশ্বিক এই মহামারী রুখতে বিশ্বনেতাদের এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। এতে ধনী দেশগুলো তাদের নাগরিকদের জন্য একটি ভ্যাকসিন রেখে বাকিগুলো অন্যদের ব্যবহারের অনুমোদন দিলে দ্রুত মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ এখনও ভ্যাকসিন ক্রয় বা গ্যাভির কাছ থেকে পাওয়ার যে আশা দেখছে তা মূলত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আবিষ্কৃত। ব্রিটেনের প্রসিদ্ধ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনটি বিশ^বাজারে সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে। এখনও পর্যন্ত এ্যাস্ট্রাজেনেকা সর্বোচ্চ দুই বিলিয়ন ভ্যাকসিন উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটও এ্যাস্ট্রাজেনেকার এই ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে। বাংলাদেশে সেরাম এর এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করছে বেক্সিমকো ফার্মা।
সম্প্রতি অক্সফোর্ডের তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল নিয়ে প্রকাশিত খবরে ভ্যাকসিনটির কার্যকরিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এতে করে অনুমোদন প্রক্রিয়াতে কোন দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হবে কি না জানতে চাইলে বেক্সিমকোর প্রধান পরিচালনা কর্মকর্তা রাব্বুর রেজা বলেন, দুটি পুরো ডোজ দেয়া হয়েছে এমন ফলাফলের ভিত্তিতে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনটির অনুমোদন চাইছে। যাদের দুটি পূর্ণ ডোজ দেয়া হয়েছে তাদের ওপর ভ্যাকসিনটি ৬২ ভাগ কার্যকর হয়েছে। ডব্লিউএইচও গাইড লাইনে ৫০ ভাগ কার্যকর ভ্যাকসিন অনুমোদন দেয়ার শর্ত দিয়েছে। সরকার এখন পর্যন্ত তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনেছে এর বাইরে আর কোন কথা হয়নি। তিনি বলেন, আমরা আলাদা করে ১০ লাখ ভ্যাকসিন আনছি। তবে সরকার যদি প্রয়োজন মনে করে বেসরকারী খাতকে সুযোগ দেয় তাহলে আরও বেশি ভ্যাকসিন আনা সম্ভব। বেসরকারীভাবে বিতরণ করা প্রতিডোজ ভ্যাকসিনের দাম সর্বোচ্চ এক হাজার ২০০ টাকা হতে পারে। এর সঙ্গে সরকার নির্ধারিত কর যুক্ত হবে। তবে এখনও এই দর চূড়ান্ত নয় বলেও জানান তিনি। অন্য কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাকসিন আমদানির চিন্তা করা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে রাব্বুর রেজা বলেন, জনসন এন্ড জনসন এবং নোভাভ্যাক্স এর ভ্যাকসিন দুটি আরও ভাল হবে বলে মনে করা হচ্ছে। দামও আমাদের নাগালের মধ্যে থাকবে বলে জেনেছি। তাদের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ হচ্ছে।
সব থেকে বেশি কার্যকর হওয়া দুটি ভ্যাকসিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। মর্ডানা বলছে তাদের ভ্যাকসিন সর্বোচ্চ ৯৪ দশমিক ৫ ভাগ কর্মক্ষম। তবে এটির দাম ৩৭ ডলার। যা অত্যধিক বলে মনে করা হচ্ছে। এর সঙ্গে ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য মাইনাস ৭০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা প্রয়োজন। অন্যদিকে ফাইজারের প্রতিডোজ ভ্যাকসিনের দামও ১৯ দশমিক ৫ ডলার। করোনা প্রতিরোধী হয়ে উঠতে হলে দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিতে হবে। এই ভ্যাকসিনটি মাইনাস ৮০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু শুধু বাংলাদেশ নয় যুক্তরাষ্ট্রেও এই তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করার কোন ব্যবস্থা নেই। যে কারণে মর্ডানা এবং ফাইজার তাদের ভ্যাকসিন ক্রেতাদের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করে দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন বাংলাদেশ চাইলেই সবার কাছ থেকে ভ্যাকসিন আমদানি করতে পারবে না। যে কোম্পানির ভ্যাকসিন ডব্লিউএইচও অনুমোদিত নয় সেই কোম্পানির ভ্যাকসিন আমদানি করা সম্ভব হবে না। চীন এবং রাশিয়ার ভ্যাকসিন আমদানির ক্ষেত্রে এই জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুটি দেশই ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের সব নিয়ম যথাযথভাবে মানছে কি না তা প্রকাশ করছে না। এতে এক ধরনের ধোয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। সেই তুলনায় এখনও তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শেষ না হওয়া জনসন এন্ড জনসন এবং নোভাভ্যাক্স এর উদ্যোগকে এগিয়ে রাখা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান দুটিই বাণিজ্যিক অনুমোদনের সব শর্ত মেনে কাজ করছে।
ভ্যাকসিন আমদানির জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে গুরুত্বপূর্ণ বলেও মনে করা হচ্ছে। যে তাপমাত্রার ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা সম্ভব নয় সেই তাপমাত্রার ভ্যাকসিন আমদানি করা হবে না। বলা হচ্ছে এখন প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের জন্য ভ্যাকসিন আমদানি করা হলেও ভবিষ্যতে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে সরকার আরও ভ্যাকসিন কিনতে পারে।
জানতে চাইলে দেশের বরেণ্য চিকিৎসক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। এতে করে মনে করা হচ্ছে ভ্যাকসিন পেতে আরও কিছু সময় প্রয়োজন হবে। আমি মনে করি দেরি একটু হয়েছে। আর একটু হলেও কোন ক্ষতি নেই।