প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই আমাদের এই উর্বর ভূমি সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে। বিভিন্ন সময় আমরা বহিরাগতদের শাসন ও শোষণের শিকার হয়েছি। চূড়ান্তভাবে ১৯০ বছরের ব্রিটিশ-রাজত্বের অংশ ও পাকিস্তানিদের দুই যুগের শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বিশ্বের বুকে আমরা এখন উন্নয়নশীল ও বিকাশমান একটি রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত। কিন্তু এই আজকের এই অবস্থানে আসার পথটা সহজ ছিল না। যুগে যুগে আমাদের ভূখণ্ডের নাম পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের ভাষা পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত মন কোনো প্রলোভনেই পা দেয়নি। আমরা পূর্বপুরুষরা চাপিয়ে দেওয়া সব কিছুর প্রতিই বিদ্রোহ করেছে। আন্দোলনমুখর এই বঙ্গ ভূমি তাই হাজার বছেরর ইতিহাসে ‘বুলগাকপুর’ বা ‘বিদ্রোহের নগরী’ বলে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত মুক্তি মিলছিল না যেনো!
তাই মহাকাল হয়তো একটি মহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় ছিল। আর বাঙালি জাতির দীর্ঘ প্রতীক্ষা ছিল একজন মহাপুরুষের আগমনের জন্য, যার প্রকাণ্ড ছায়াতলে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার অপেক্ষায় ছিল সবাই। কালের আবর্তনে ঠিক তেমন কারো আগমনী বার্তাও শোনা যাচ্ছিলো, কৈশোরে সামাজিক ন্যায্যতার আন্দোলন এবং তারুণ্য-যৌবনে ব্রিটিশ বিরোধী ও মানুষের অধিকারের আন্দোলনের মাধ্যমে ঠিক তেমনই একজন যেনো তৈরি হচ্ছিলেন ভবিষ্যতের জন্য। পরিণত সময়ে যিনি বাঙালির জাতির মুক্তি সংগ্রামে চূড়ান্তভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন- তিনিই শেখ মুজিবুর রহমান। এই বঙ্গভূমিকে শোষণমুক্ত করার দীর্ঘ সংগ্রাম-আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ তিনি। তিনিই বঙ্গবন্ধু- তার কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। তিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, স্বাধীন সার্বভৌম বাঙালি জাতির পিতা।
বাংলা ভাষা তো এই অঞ্চলে আগে থেকেই ছিল কিন্তু বাংলাদেশ নামটি কীভাবে এলো? এটি এখন আলোচনার বিষয়। কারণ যুগে যুগে বহুবার এই অঞ্চলের নাম বদল হয়েছে। যখন যারা শাসন করেছে, তারা তাদের নিজেদের মতো করে নাম দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাদের কেউ কেউ এই অঞ্চলকে বিশেষিত করেছেন দোজখ বলে, আবার কেউ অভিহিত করেছেন বেহেশত হিসেবে। কিন্তু হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য অনুসারে এই অঞ্চলটি বঙ্গ বা বাংলা নামেই অধিক পরিচিত ছিল।
আধুনিক কালে এই ভূখণ্ডের নামের অংশ থেকে বাংলা শব্দটি বদলের জন্য পাকিস্তানিরা যে অপপ্রয়াস চালিয়েছে সেদিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত আমরা ছিলাম বৃহত্তর বঙ্গের অংশ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বঙ্গ-প্রদেশ ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত হয়ে হয় পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গ। পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তানে এবং পশ্চিম বঙ্গ ভারতের অংশ হয়। সেসময় পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার নাম দেয় পূর্ব পাকিস্তান এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে উর্দুকে। কিন্তু আপামর বাঙালির কাছে এই নাম ও ভাষা কোনোটাই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ১৯৫২ সালে রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করা হয়। এদিকে বাংলাকে মাতৃভাষা স্বীকৃতির দাবিতে ১৯৪৮ সাল থেকেই আন্দোলন শুরু করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, একারণে তাকে একাধিকবার জেলে যেতে হয় এবং বিভিন্ন অযুহাতে গ্রেফতার হতে থাকেন তিনি। তারই এক পর্যায়ে ১৯৪৮ সালের অক্টোবরে আটক হয়ে প্রায় তিন বছর চার মাস কারাবাস করে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পান। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে আওয়ামী লীগের একজন প্রতিনিধি হিসেবে চীনের পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ পান। সেখানকার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি ডায়েরিতে যা লিখেছিলেন, তা পরবর্তীতে ‘আমার দেখা নয়া চীন’ নামের একটি গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালের সেই ভ্রমণে চীনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে নিজের দেশকে অনুভব করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি বাহিরের দিক থেকে দেশটাকে ভালো করে দেখতে লাগলাম। মনে হলো, এ তো আমার পূর্ব বাংলার সকল কিছু। সবুজ ধানের ক্ষেত, চারদিকে বড় বড় গাছ। মাঝে মাঝে মাটির ঘরের গ্রাম। ছোট ছোট নদী।’ পশ্চিম পাকিস্তানিরা এই দেশকে পূর্ব পাকিস্তান নামে ডাকলেও বঙ্গবন্ধুর কাছে এটি তখনও পূর্ব বাংলা। বাংলা নামের পরিবর্তন তিনি মানতে পারেন নাই।
এই প্রসঙ্গে ১৯৫৭ সালের আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। সেসময় করাচিতে পাকিস্তানের গণপরিষদের তরুণ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা দেওয়ার সময় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটির প্রতিবাদ করে বলেন- ‘পূর্ব বাংলা নামের একটি ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। আর যদি পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতেই হয়, তাহলে বাংলার মানুষের জনমত যাচাই করতে হবে। তারা নামের এই পরিবর্তন মেনে নেবে কিনা, সেজন্য গণভোট নিতে হবে।’
পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশ নামটি স্লােগানে স্লােগানে ব্যবহৃত হতে থাকে। এসময় পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। শোষণে ক্লান্ত আপামর জনতা তখন স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর। সেই সময়ের গণ-আন্দোলনে একটি স্লোগান নিয়মিতই দেওয়া হতো- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। এরকম একটি পরিস্থিতিতে ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর গণতন্ত্রের মানসপুত্র শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’।
বঙ্গবন্ধু ওই আলোচনা সভায় বলেন, ”এক সময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোনও কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এর পরিবর্তে শুধু ‘বাংলাদেশ’।” এই ঘোষণার ব্যাপারটি বঙ্গবন্ধু রচিত কারাগারের রোজনামচা বইয়ে উল্লেখ করা আছে।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু কর্তৃক এই দেশের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশ’ ঘোষণার পর মাওলানা ভাসানী ও আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধুর ওই নামকরণের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন পরের দিনের অবজারভার পত্রিকায়। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের ‘বঙ্গবন্ধু কীভাবে স্বাধীনতা এনেছিলেন’ বইটিতে এসব নিয়ে বিস্তারিত তথ্য আছে।
‘বাংলাদেশ’ নামকরণের সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা ঘোষণায়ও এই ভূখণ্ডকে ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ইপিআর-এর বেতার বার্তা এবং পরবর্তীতে কালুরঘাট থেকে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণায়ও স্বাধীন দেশের নাম ‘বাংলাদেশ’ বলা হয়েছে। পরবর্তীতে মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার যে ঘোষণা প্রচার করে, তাতেও বলা হয় এই দেশটির নাম হলো ‘বাংলাদেশ’। দেশ স্বাধীনের পরে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর যখন প্রথম সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয় সেই সময়ও সাংবিধানিক নাম দেওয়া হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। আর এই স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ভাষা যতদিন থাকবে, এই ভূমি যতদিন থাকবে, ততদিন এদেশের মানুষের মনে ও মননে তিনি বেঁচে থাকবেন।