প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই বাহিনী গড়ে উঠেছে। কাজেই এই বাহিনীর প্রতিটি সদস্য দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের আপনারা গড়ে তুলবেন, যেন সব সময় জনগণের পাশে থেকে জনগণের কল্যাণে কাজ করেন।
‘বাংলাদেশ যুদ্ধ নয় শান্তি চায়’- দেশের এই পররাষ্ট্রনীতির কথা পুনরুল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এলে প্রতিঘাত করার মত সক্ষমতা অর্জনে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। কিন্তু কেউ যদি আমাদের সার্বভৌমত্বে আঘাত করতে আসে, প্রতিঘাত করবার মতো সক্ষমতা যেন আমরা অর্জন করতে পারি- সেভাবেই আমাদের প্রশিক্ষণ এবং প্রস্তুতি থাকতে হবে। এ বিষয়টি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সবসময় মনে রাখতে হবে। কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় তাদের ধন্যবাদও জানান প্রধানমন্ত্রী।
রবিবার মিরপুর সেনানিবাসের শেখ হাসিনা কমপ্লেক্সে ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স (এনডিসি)-২০২০ এবং আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স (এএফডব্লিউসি)-২০২০ এর গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।
ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের কমানড্যান্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। আইএসপিআর’এর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জানায়, এ বছর ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স-২০২০ এ (এনডিসি) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩১ জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর চার কমোডর এবং একজন ক্যাপ্টেন, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পাঁচ জন এয়ার কমোডর রয়েছেন। সশস্ত্র বাহিনী অফিসারদের পাশাপাশি দু’জন অতিরিক্ত সচিব, ১১ জন প্রশাসনের যুগ্ম সচিব এবং সিভিল সার্ভিসের অন্যান্য ক্যাডার, বিদেশী পরিষেবা থেকে একজন মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ পুলিশের দুইজন উপ-মহাপরিদর্শক এতে অংশ নিয়েছিলেন।
১২টি বন্ধু দেশের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল/ কর্নেল এবং সমমানের পদমর্যাদার ২৫ জন সদস্যও অংশগ্রহণ করেন। এ বছর আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্সে তিনজন কর্নেল এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৩ জন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, দু’জন ক্যাপ্টেন এবং ছয় জন কমান্ডার বাংলাদেশ নৌবাহিনী থেকে এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে সাত গ্রুপ ক্যাপ্টেন এবং একজন উইং কমান্ডার অংশগ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গা ইস্যু দ্রুত সমাধানে আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার থেকে আমাদের দেশে তাদের প্রায় ১০ লাখের ওপরে নাগরিক আশ্রয় নিয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে কখনও সংঘাতে যাইনি এবং আলোচনার মাধ্যমে এটা সমাধানের চেষ্টা করছি এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সকলকে আমরা আহ্বান জানিয়েছি- এই যে বিশাল একটা বোঝা আমাদের ওপর রয়েছে-এটার যেন তারা দ্রুত সমাধান করেন।
জাতির পিতার করে যাওয়া দেশের পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়,’ এর কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেছে। সব থেকে বড় কথা আমাদের দেশের উন্নতি করতে হবে। তার জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে যেখানে এবং যাদের কাছ থেকে যতটুকু সহযোগিতা পাওয়া যায়, প্রযুক্তি জ্ঞান পাওয়া যায়, সেটুকু নিয়েই আমরা আমাদের দেশকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই কথাটা মনে রাখতে হবে, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আমরা রাখব। নিজের দেশের নিরাপত্তা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী সর্বদা প্রস্তুত থাকবে এবং আমরা সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি এবং সেকারণে সারাবিশ্বে আজকে আমরা মর্যাদা পেয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা। এর সুফল বাংলার প্রতিটি মানুষের ঘরে আমরা পৌঁছে দিতে চাই। চলমান মুজিববর্ষ থেকে আগামী বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালীন দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি ভূমিহীন, গৃহহীনকে অন্তত একটি করে ঘর করে দেয়ায় তার সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে তিনি চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সকলকে স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনে চলার আহ্বানেরও পুনরুল্লেখ করেন।
‘মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠেছে’, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বাহিনীর প্রতিটি সদস্য দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের আপনারা গড়ে তুলবেন। যেন সবসময় জনগণের পাশে থেকে জনগণের কল্যাণে কাজ করেন। তিনি সবসময় দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, কোভিড-১৯ এর সময় নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে রেখেও আপনারা ব্যাপকভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সেবা দিয়েছেন। সেজন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
একটি শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠা করার জাতির পিতার স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে তার কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু একটি আধুনিক, সুশিক্ষিত ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে ১৯৭৪ সালে প্রণয়ন করেন প্রতিরক্ষা নীতি। সেই নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আমরা সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নে ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ প্রণয়ন করে তা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করছি। ’৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর সরকারে এসেই ক্ষুদ্র পরিসরে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের উচ্চমানের প্রশিক্ষণ ও উচ্চ শিক্ষার কথা বিবেচেনা করে ১৯৯৮ সালে আমরা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ। বর্তমানে এটি একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
নবীন গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯-এর একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করে স্ব-স্ব কোর্স সম্পন্ন করে আপনারা আজকে স্ব-স্ব কর্মস্থলে যোগ দেবেন। আপনাদের জীবন সফল হোক, আমি সেটাই চাই। আমি আশাবাদী যে, এনডিসি তার প্রশিক্ষণে উচ্চমানের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবেন এবং এই প্রতিষ্ঠানের গ্র্যাজুয়েটগণ আপনারা আপনাদের অর্জিত জ্ঞান, ইচ্ছাশক্তি এবং অঙ্গীকারকে সামনে রেখে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে একটি স্থিতিশীল, টেকসই, উন্নয়ন আত্মনির্ভরশীলতা সর্বোপরি গৌরবময় অবস্থানের দিকে নিয়ে যাবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা যেন কখনও ব্যর্থ না হয়। আমাদের দেশকে যেন উন্নতির উচ্চ শিখরে নিয়ে যায়। সারাবিশ্বের কাছে সবসময় আমরা যেন মাথা উঁচু করে বিজয়ী জাতি হিসেবে চলতে পারি। আপনারা যেখানেই যাবেন বিজয়ী জাতি হিসেবে আত্মমর্যাদা বোধ নিয়ে আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে চলবেন।