নয় মাসের যুদ্ধ, ত্যাগ-তিতিক্ষা আর এক নদী রক্তের বিনিময়ে বিজয় অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের। গতকাল ছিল কাঙ্ক্ষিত সেই বিজয়ের দিন- ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের ৪৯তম বার্ষিকীতে সর্বস্তরের মানুষ বিজয়োল্লাসে নেমেছিল রাজপথে। রাজধানীসহ সারাদেশ গতকাল বুধবার হয়ে উঠেছিল লাল-সবুজের নদী। কভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সাংস্কৃতিক অঙ্গন।
রাজধানীতে বিনোদনকেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি হাতিরঝিল এবং টিএসসি এলাকায়ও ঢল নেমেছিল মানুষের। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে হয়েছে নানা অনুষ্ঠান। পাড়া-মহল্লায় বেজেছে দেশাত্মবোধক গান ও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। বিভিন্ন ভবনে তোলা হয় জাতীয় পতাকা। সন্ধ্যায় ঝাড়বাতি আর রংবেরঙের পতাকায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ভবন, বাড়ি, সড়ক, সড়কদ্বীপ। শহীদদের আত্মার শান্তি, জাতির সমৃদ্ধি কামনা করে সব ধর্মের উপাসনালয়ে হয়েছে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা। হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রম ও এতিমখানায় পরিবেশন করা হয় উন্নত মানের খাবার।
গতকাল নানা আয়োজনে ফুটিয়ে তোলা হয় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও আত্মত্যাগের আখ্যান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষে এ বিজয় দিবস নিয়ে আসে আলাদা তাৎপর্য। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে বাংলাদেশে এবারের বিজয়ের উৎসব আরও বড় পরিসরে উদযাপনের কথা থাকলেও তাতে বাদ সেধেছে করোনাভাইরাস মহামারি। তার পরও গানে, আবৃত্তি আর নাচের মুদ্রায় বিজয়ের উল্লাস বয়েছে গোটা রাজধানীজুড়ে।
শিল্পকলা একাডেমি : আলোচনা, নাচ-গান, আবৃত্তিসহ নানা মনোজ্ঞ আয়োজনে বিজয়ের ৪৯তম বার্ষিকী উদযাপন করেছে শিল্পকলা একাডেমি। বিজয়ের প্রভাতে একাডেমির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শুরু করে তাদের কর্মসূচি।
এরপর সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত জাতীয় স্মৃতিসৌধে কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি আসাদ মান্নান, নূরুল হুদা, আসলাম সানি ও রহিমা আক্তার কল্পনা। আবৃত্তি করেন মজুমদার বিপ্লব, তামান্না তিথি, আব্দুল রাকিবিল বারী, মাসকুর-এ-সাত্তার কল্লোল, আবু নাসের মানিক। সমবেত সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা। একক কণ্ঠে সংগীত পরিবেশন করেন রুকসানা আক্তার রূপসা, সুচিত্রা রানী সূত্রধর, সোহানুর রহমান সোহান, আবিদা রহমান সেতু, রাফি তালুকদার, মোহনা দাস, কোহিনুর আক্তার গোলাপী, স্মরণ প্রমুখ। দ্বৈত সংগীত পরিবেশন করেন সাব্বির জামান ও রাজিব।
একাডেমির অ্যাক্রোবেটিক দলের শিশু বিভাগ ও বড়দের দল পরিবেশন করে মনোমুগ্ধকর অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনী। লিয়াকত আলী লাকীর রচনা ও নির্দেশনায় বাঙলা কলেজ যুব থিয়েটার মঞ্চায়ন করে নাটক ‘মুজিব মানে মুক্তি’।
‘সাহসী তারুণ্যে আগামীর বাংলাদেশ’ শিরোনামে চারুশিল্পীদের অংশগ্রহণে আর্টক্যাম্পে অংশ নেন জাহিদ মুস্তফা, সনজীব দাস অপু, সৈয়দা মাহবুবা করিম (মিনি করিম), আলক্তগীন তুষার, শামসুল আলম আজাদ, রিফাত জাহান কান্তা, মুক্তি ভৌমিক, মনি দীপা দাসগুপ্তা, জাকির হোসেন পুলক ও তৈমুর হান্নান।
দ্বিতীয় পর্বে সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ পর্বের শুরুতেই জাতীয় নাট্যশালার লবিতে অতিথিদের স্বাগত জানায় নৃত্য সংগঠন স্পন্দন। জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তন মঞ্চে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কণ্ঠশিল্পীরা পরিবেশন করেন জাতীয় সংগীত।
আলোচনা পর্বে অনলাইনে মুখ্য আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান। প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। অনলাইনে যুক্ত ছিলেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। স্বাগত বক্তৃতা করেন একাডেমির সচিব মো. নওসাদ হোসেন।
আলোচনা শেষে সমবেত সংগীত পরিবেশন করেন একাডেমির সংগীতশিল্পীরা। একক সংগীত পরিবেশন করেন তিমির নন্দী, দিনাত জাহান মুন্নী, পিন্টু ঘোষ, রাজীব, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস ও বুলবুল মহলানবীশ। অনিক বোসের নৃত্য পরিচালনায় সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে স্পন্দন। লিয়াকত আলী লাকীর ভাবনা ও পরিকল্পনায় ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ নৃত্যালেখ্য পরিবেশন করেন শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যশিল্পীরা। আবৃত্তি করেন আশরাফুল আলম। সবশেষে অ্যাক্রোবেটিক পরিবেশন করে শিশুশিল্পীরা। ক্যাপ ডান্স, হাই সাইকেল ব্যালেন্স, রোপ ডাউন্ড, রিং জাম্প, হাঁড়ি ও লাঠি, রোপ জাম্প এবং সাউদিয়ার মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা মিলনায়তনে আগতদের আকর্ষিত করে রাখে। বড়দের পরিবেশনায় ছিল হ্যান্ড স্কিল, রোলার ব্যালেন্স, মাউথ স্কিল, ব্যারেল ব্যালেন্স, নেক আয়রন বার, টপ টু আমব্রেলা, ফায়ার ডান্স, চেয়ার সেটিং, বডি ব্যালেন্স এবং নুনথু।
জাতীয় জাদুঘর :আলোচনা ও সেমিনারের মধ্য দিয়ে বিজয়ের ৪৯তম বার্ষিকী উদযাপন করেছে জাতীয় জাদুঘর। গতকাল জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনের এই আয়োজনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকে নানামাত্রিকভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের নন; তিনি ছিলেন বিশবন্ধু। তিনি বলতেন, ইতিহাস জানা দরকার; ইতিহাস বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের টেবিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়ে গিয়ে তার তত্ত্বাবধানে রাখে। পরে কর্মকর্তা ড. ফিরোজ মাহবুব সেই ঐতিহাসিক টেবিলটি জাদুঘরে আনেন। এটি ইতিহাসের দুর্বলতা। বঙ্গবন্ধু সব রকমের মানুষ নিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান সেই ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে কুঠারাঘাত করেছেন। জিয়া এবং এরশাদ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে এদেশে মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। যে কারণে আজ তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার স্পর্ধা দেখাচ্ছে। এদের মৌলবাদী বলা যাবে না। এরা হলো গোঁড়া ধর্মান্ধ ও পশ্চাৎপদ জালেম গোষ্ঠী। বঙ্গবন্ধুর আদর্শায়িত বাংলাদেশ গড়তে হলে শুধু অবকাঠামোগতভাবে এগোলেই হবে না; বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করতে হবে। সমাজের বৈষম্য কমাতে হবে।
বিপিপির আলোচনা সভা :বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজধানীর আইইবি সেমিনার হলে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ (বিপিপি) সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভা করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান, আইইবির ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী খন্দকার মনজুর মোর্শেদ, প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন, প্রকৌশলী এসএম মনজুরুল হক মঞ্জু, সম্মানী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. শাহাদাৎ হোসেন শীবলু প্রমুখ। এর আগে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ-এর (আইইবি) সামনে নবনির্মিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিপিপি, আইইবি সদর দপ্তর ও ঢাকা কেন্দ্রের নেতারা।
কদমতলীতে আলোচনা সভা :রাজধানীর কদমতলীতে বিজয় দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকালে ‘প্রত্যহ ভাল থাকি’ শরীরচর্চা সংগঠনের (প্রভাথা) উদ্যোগে এ আলোচনা সভা হয়। সংগঠনের সভাপতি মো. সাখাওয়াত হোসেনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মো. মাসুদ আলীর পরিচালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সাবেক মেম্বার মো. মহশিন, মাশরেকুল আনোয়ার, মো. আব্দুল মান্নান, মো. আবুল হোসেন, হাজি শামীম আহমেদ সামু, এবিএম আহসান দিপু, মো. খোরশেদ আলম শিকদার, আব্দুল কাদের, ওয়াহিদ, মো. মিল্টন প্রমুখ। ডিএনসিসি ওয়ার্ড ৪২ (বেরাইদ) :বিজয় দিবস ২০২০ উদযাপনে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ৪২ নং ওয়ার্ড (বেরাইদ) আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন। ভোরে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব আনছার মিন্টু। এতে উপস্থিত ছিলেন সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফারুক আহম্মেদ ও স্থানীয় নেতারা। বিকেলে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
এ ছাড়া বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করেছে বাংলাদেশ গ্রন্থসুহৃদ সমিতি, বেরাইদ গণপাঠাগার, একেএম রহমতুল্লাহ কলেজ, বেরাইদ মুসলিম হাই স্কুল, রওশনআরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, আলহাজ রাহীমুল্লাহ মোল্লা দাখিল মাদ্রাসা ও এতিমখানা, বেরাইদ মোহাম্মদিয়া দাখিল মাদ্রাসা, শতদল জুনিয়র হাই স্কুল, বেরাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেরাইদ মডেল স্কুল, আল-ফালাহ আইডিয়াল স্কুল, প্যারাডাইজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, কিডস গার্ডেন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ফকিরখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আবদুল মতিন একাডেমি।