অবশেষে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে দৃশ্যমান হলো। ১০ ডিসেম্বর ৪১তম স্প্যানটি বসানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশব্যাপী এ নিয়ে যে আনন্দের বহির্প্রকাশ ছড়িয়ে পড়েছে তার প্রধানতম কারণ হলো বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতুর অবকাঠামো নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হওয়া। দেশি-বিদেশি অনেকের কাছেই এটি এক সময় অবিশ্বাস্য ছিল কারণ পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এই সেতু সবচেয়ে খরস্রােতা নদীর ওপর নির্মাণ করার বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলেও ছিল নানা ধরনের সন্দেহ ও প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত হয়েছিল অর্থসংস্থানের অনিশ্চয়তা এবং দেশে-বিদেশে প্রচারিত নানারকম কল্পকাহিনি। তবে সব সন্দেহ, অবিশ্বাস এবং প্রচার-প্রোপাগান্ডা অতিক্রম করে অবশেষে পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। আগামী ৭-৮ মাসের মধ্যে এই মূল কাঠামোর ওপর রেললাইন ও পরিবহন সড়ক তৈরির কাজ সমাপ্ত হবে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আগামী বছরের বিজয় দিবসের প্রাক্কালে সেতুর ওপর দিয়ে রেলসহ সব ধরনের পরিবহন চলাচল উদ্বোধন করা হবে। ১০ ডিসেম্বর ৪১তম তথা সর্বশেষ স্প্যানটি বসানোর মাধ্যমে পদ্মা সেতুর সবচেয়ে কঠিন ও জটিল কারিগরি কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এটি আনন্দঘন এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত যা গোটা জাতি এবারের বিজয় দিবসের প্রাক্কালে প্রকাশ করার সুযোগ পেল। এর মাধ্যমে পদ্মার পূর্ব পারের মাওয়া এবং পশ্চিম পারের জাজিরার মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হলো- যা প্রমত্তা পদ্মার অনতিক্রম্য দূরত্বকে ঘুচিয়ে দিয়ে সারাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯টি জেলার নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের দ্বার উন্মোচন করল। আগামী বছর এই সময়ে দক্ষিণ বাংলার ২৯টি জেলার মানুষ দেশের অপর অঞ্চলের সঙ্গে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যাতায়াত শুরু করবে, দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষজনও একইভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত শুরু করবে। এই সেতু বাংলাদেশের সব অঞ্চলের সঙ্গে মানুষের যাতায়াত সংযোগ স্থাপন করবে যা ইতিহাসের এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।
প্রমত্তা পদ্মা নিয়ে আমাদের দেশে শত শত বছর ধরে এক ধরনের ভয়ভীতি ছিল। পদ্মার তীব্র খরস্রােত যেমন ছিল ভীতিকর, তেমনি এর বিশাল ব্যাপ্তিও মানুষকে ভয় পাইয়ে দিত। তাই এমন ভয়ঙ্কর খরস্রােতা ও বিশাল ব্যাপ্তির এই পদ্মা নদীর ওপর কখনো সেতু নির্মিত হবে এটি বেশিরভাগ মানুষেরই কল্পনার বাইরে ছিল। যুগ যুগ ধরেই বিভিন্ন ফেরিঘাট দিয়ে মানুষকে নানা অবর্ণনীয় দুর্ভোগ অতিক্রম করে এই প্রমত্তা নদী পার হতে হচ্ছে। সেই পদ্মার ওপরই এখন সেতু হচ্ছে, আগামী বছর থেকে আর মানুষকে ফেরি পারাপারের দুঃখ, কষ্ট কিংবা দুর্ভোগ কিছুই পোহাতে হবে না। এই বিষয়টি দক্ষিণ বাংলার ২৯টি জেলার মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আনন্দের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে। যাতায়াতের এই অন্তহীন সমস্যা ও দুর্ভোগের কারণে এতদিন দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত দেশের তিন ভাগের এক ভাগ ভূখ-ে উন্নয়নের ছোঁয়া যথাযথভাবে লাগতে পারেনি। তবে আগামী বছরের পর থেকে এই বন্ধ্যত্ব কেটে যাবে, সৃষ্টি হবে উন্নয়নের নতুন বাতাবরণ- সেখানে কৃষি, মৎস্য, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা- দ্রুত সম্প্রসারিত হবে, যা গোটা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলেই অমাদের দঢ়বিশ্বাস। বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে হিসাব করে বলছেন যে, পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ার পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি ২.৩ শতাংশ এবং বাংলাদেশের জিডিপি প্রতিবছর ১.২৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে দারিদ্র্য কমবে ১.০৯ শতাংশ হারে। সুতরাং পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সব অঞ্চলকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের এক মহাসড়কে একইসঙ্গে নিয়ে যাবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং আমরা আশা করতেই পারি পদ্মা সেতু আমাদের বাংলাদেশকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে উত্তরণ ঘটাতে ব্যাপক অবদান রাখবে।
স্বপ্নের এই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর ২০০১ সালের ৪ জুলাই সেই সময়ের সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থাপন করেছিলেন, তখন অনেকেই এই ভিত্তিপ্রস্তরকে নির্বাচনী চমক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনাকে ইউটোপিয়ান চিন্তা বলে অনেকেই প্রচার করেছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করতে পারেনি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে তখন পদ্মা সেতুর বিষয়ে কোনো উদ্যোগ তো নেয়ইনি বরং উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের জন্য নতুন করে সম্ভাব্যতা জরিপের দোহাই দিয়ে চলমান কার্যক্রমও বন্ধ করে দিয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর বিষয়ে তার অঙ্গীকারের কথা পুনরুল্লেখ করেছিলেন। বিশ্বব্যাংক তখন পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়নের আগ্রহ প্রকাশ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু ২০১০-২০১১ সালে পদ্মা সেতু নিয়ে দেশে দুর্নীতির কল্পকাহিনি ছড়ানো হয়। অথচ তখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পের জন্য প্রাক্কলিত কোনো অর্থই ছাড় করেনি। বিরোধী রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম এবং বিশেষ কিছু মহল দেশে দুর্নীতির কল্পকাহিনি এতটাই ছড়িয়ে দিয়েছিল যে, পদ্মা সেতু নিয়ে আপামর জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ-অবিশ্বাস অনেকটাই দানা বাঁধতে শুরু করে। এই অপপ্রচারের পেছনে বিদেশি কোনো কোনো মহলও জড়িত ছিল- যার প্রমাণ পরবর্তী সময়ে পাওয়া যায়। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক আকস্মিকভাবে প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদানে অসম্মতি জানায় এবং কথিত দুর্নীতির অজুহাতে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়, যা বিরোধী দলসহ অন্যান্য কুচক্রী মহলকে সরকারবিরোধী প্রচারণায় দ্বিগুণ উৎসাহ জোগায়। পদ্মা সেতু বিরোধী ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার এবং প্রোপাগান্ডার এখানেই শেষ নয়, বরং বিশ্বব্যাংকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাও এই প্রকল্প থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। এমন এক বৈরী পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের মধ্যে পদ্মা সেতুর আকাক্সক্ষা অনেকটাই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতাগোষ্ঠী এবং দেশের সব বিরোধী মহলের অযৌক্তিক অবস্থানের বিরুদ্ধে যে শুধু রুখে দাঁড়িয়েছেন তাই-ই নয়, তিনি সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জও গ্রহণ করলেন। তার এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের দৃঢ়তা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দেশপ্রেমিক জনগণ সমর্থন করে, কিন্তু বিরোধী পক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টিকে অবাস্তব, কাল্পনিক এবং দেশে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা বলে প্রচার-প্রচারণা চালাতে থাকে। এমন একটি চরম বৈরী পরিবেশে দেশের সেতু বিশেষজ্ঞদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় চীনা কারিগরি বিশেষজ্ঞদের। প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশলীদেরও যুক্ত করা হয়। ২০১৫ সাল থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হয়। প্রমত্তা পদ্মার ভৌগোলিক অবস্থান ও গঠনগত প্রাকৃতিক কাঠামোর কারণে নদীর তলদেশে সৃষ্ট নানান জটিলতায় সেতুর নকশায় কিছুটা পরিবর্তন করা হলেও বিদেশ থেকে আনা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও কারিগরি সহযোগিতা নিয়ে অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখা হয়েছে। স্প্যানগুলো বসানো শুরু হওয়ার পর একটি মহল আবারও অপপ্রচারে নামে। পদ্মা সেতুর জন্য নাকি শিশুর মাথার প্রয়োজন হবে। এমন ভয়ঙ্কর সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টিকারী গুজব ছড়িয়ে সারাদেশে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছিল। এই আতঙ্ক ছড়ানোর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ মনোভাব জাগিয়ে তোলা। একদিকে সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা, অন্যদিকে এসব কুসংস্কার ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সরকারকে কাজ করতে হয়েছে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয়ভার বৃদ্ধি নিয়েও নানারকম অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
এ বছর করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবের পর বলা হয়েছিল, পদ্মা সেতুর কাজ থেমে যাবে এবং ব্যয়ভার আরও বেড়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। আমরা জানি যে করোনা মহামারীতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ একদিনও থেমে থাকেনি, প্রায় চার হাজার প্রকৌশলী ও শ্রমিক এই করোনাকালেও স্প্যান তৈরি ও বসানো, রেল ও সড়ক পথের জন্য প্রয়োজনীয় স্লিপার বসানোসহ সেতুর সংযোগ সড়কের কাজ পুরোদমে অব্যাহত রেখেছেন। ৪১তম স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে প্রমত্তা পদ্মার ওপর মূল ৬.১৫ কিলোমিটারের সেতুটি সম্পূর্ণ দৃশ্যমান হওয়ার পাশাপাশি পদ্মার পূর্ব পারের মাওয়া ও পশ্চিম পারের জাজিরার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কাজটি সম্পন্ন হলো। আর এর মাধ্যমে পদ্মা সেতুর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে, বাকি কাজ আগামী ৭-৮ মাসের মধ্যে সমাপ্ত হবে, তখন পদ্মা সেতু হবে সারাদেশের মানুষের যাতায়াতের সবচেয়ে বড় সেতু। এই সেতুটি নির্মাণের মাধ্যমে শেখ হাসিনা আমাদের জাতীয় জীবনে আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সেটি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় গৌরবময় অর্জন। এখন থেকে বিশ্বের কোনো দাতা সংস্থা বাংলাদেশকে হেয় কিংবা অবহেলা করার সাহস পাবে বলে মনে হয় না। বরং ইতোমধ্যেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বিভিন্ন দেশ এবং দাতা সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা সম্পর্কে যথেষ্ট ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছে। অনেক দাতা সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত অনেক দেশই এখন বাংলাদেশের বেশকিছু মেগা প্রকল্পে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা নিয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। এর ফলে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বড় বড় প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে একদিকে যেমন অভিজ্ঞ হচ্ছেন, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় তাদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনায় গত ১২ বছর যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন তা বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল এবং আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্রের কাতারে স্থান করে দিয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তাল মিলিয়ে চলার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সক্ষম করলেন।