নতুন বছরে আরও একটি স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর। দেশের সর্বদক্ষিণের কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত চালু হচ্ছে ফেরিবিহীন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। আসছে জুনের শেষভাগে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে ঢাকা-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের লেবুখালী সেতু। পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করতে বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার মধ্যবর্তী পায়রা নদীর ওপর সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে নান্দনিক নকশায় এক্সট্রাডোজ ক্যাবল স্টেট পদ্ধতিতে।
আগামী জুনের শেষদিকে বহুল প্রত্যাশিত সেতুটি উন্মুক্ত করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের সড়ক যোগাযোগে নতুন মাইলফলক স্থাপন করতে যাচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার। নব্বই দশকেও রাজধানী ঢাকা থেকে সড়কপথে বরিশাল জেলা সীমানায় প্রবেশের পর সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটায় যেতে সাতটি ফেরি পার হতে হতো। প্রতিটি ফেরিঘাটে দীর্ঘ অপেক্ষা, ভোগান্তি আর হয়রানির কারণে পর্যটকদের কাছে সাগরকন্যা কুয়াকাটা ছিল এক দুঃস্বপ্নের নাম। পর্যায়ক্রমে শিকারপুর, দোয়ারিকা, পটুয়াখালী, দপদপিয়া, কলাপাড়া, মহিপুর এবং আলীপুর পয়েন্টে সেতু নির্মিত হলেও পায়রা নদীর লেবুখালী ফেরিঘাটে বিড়ম্বনা সইতে হয়েছে কুয়াকাটাগামী পর্যটকসহ দক্ষিণের মানুষের। যানবাহনের চাপের কারণে ফেরিঘাটে কেটে যেত দিনের একাংশ। তবে সেই চিত্র আর থাকছে না। নতুন বছরেই ফেরিবিহীন সড়ক যোগাযোগে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে বরিশালে। পায়রা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য ২০১২ সালে একটি প্রকল্প প্রণয়ন করে সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয়। ওই বছরের ৮ মে পায়রা সেতু নির্মাণ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয়। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রা সেতুর ভিত্তি উদ্বোধন করেন। ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের লংজিয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ কোম্পানি লিমিটেডকে সেতু নির্মাণের কার্যাদেশ দেয় সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পে যৌথভাবে অর্থায়ন করে কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (কেএফএইডি) এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওএফআইডি)। কার্যাদেশ প্রদানের সময় সেতুর প্রাক্কলন ছিল ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেতু নির্মাণের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। প্রথম কার্যাদেশের মেয়াদ ছিল ৩৩ মাস। এরপর দুই দফায় সময় বৃদ্ধি করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। পায়রা সেতু প্রকল্পের উপ-ব্যবস্থাপক কামরুল আহসান জানান, ৮৪০ মিটার ভায়াডাক্ট এবং ৬৩০ মিটার মূল সেতুসহ পায়রা সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪৭০ মিটার এবং প্রস্থ ১৯.৭৬ মিটার। নদীর উত্তর প্রান্তে ৬১০ মিটার এবং দক্ষিণে ৬৫৮ মিটারসহ দুই পাশে মোট অ্যাপ্রোচ সড়ক ১ হাজার ২৬৮ মিটার। বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত পায়রা সেতু প্রকল্পের মোট ৬৬ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে বক্সগার্ডার পদ্ধতিতে মূল সেতুর ৬৩০ মিটারের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে ৪৫০ মিটার (৭৮ ভাগ)। ভায়াডাক্ট ৮৪০ মিটারের সবটুকুই সম্পন্ন হয়েছে। দুই পাশে অ্যাপ্রোচ সড়কের কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৪৫ ভাগ। বর্তমানে দিনরাত কাজ চলছে ১৮, ১৯ ও ২০ নম্বর পিলারে বক্সগার্ডার নির্মাণে। এই ৩টি পিলারে পাইলন টাওয়ার থেকে ৬টি করে ক্যাবলে ঝুলে থাকবে মূল বক্সগার্ডার সেতু। মোট ৩১টি পিলারের ওপর ৩২টি স্প্যানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে পায়রা সেতু। ভায়াডাক্টে আই গার্ডারের ওপর ২৮টি স্প্যান এবং মূল সেতুর চারটি স্প্যান হচ্ছে বক্সগার্ডার টাইপের। মূল সেতুর প্রথম স্প্যান ১১৫ মিটার, দ্বিতীয় স্প্যান ২০০ মিটার, তৃতীয় স্প্যান ২০০ এবং চতুর্থ স্প্যান ১১৫ মিটার দীর্ঘ। এই সেতুতে স্থাপন করা ২০০ মিটার দীর্ঘ স্প্যান বাংলাদেশে আর কোনো সেতুতে নেই (পদ্মা সেতুতে সর্বোচ্চ ১৫০ মিটার দীর্ঘ স্প্যান বসানো হয়েছে)। মূল ৩টি (১৮, ১৯ ও ২০ নম্বর) পিলার স্থাপন করা হয়েছে ভাটির সময় পানির স্তর থেকে ১৩০ মিটার দৈর্ঘ্যে (৪২ তলা ভবনের সমান) নদীর তলদেশে। পদ্মা সেতুতে বসানো হয়েছে ১২০ মিটার পাইল। পায়রা সেতু প্রকল্প ব্যবস্থাপক আহমেদ শরীফ সজিব জানান, পর্যটনের কথা বিবেচনায় রেখে পায়রা সেতু নির্মিত হচ্ছে চট্টগ্রামের শাহ্ আমানত সেতুর আদলে এক্সট্রাডোজ ক্যাবল স্টেট পদ্ধতিতে নান্দনিক নকশায়। সৌরবিদু্যুতের আলোয় রাতে নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারণা হবে পায়রা সেতুতে। সড়ক ও জনপথ অধিদফতর বরিশাল জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবু হেনা মো. তারেক ইকবাল জানান, আগামী জুনের শেষভাগে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে পায়রা সেতু। এই সেতু উদ্বোধন হলে বরিশাল থেকে পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা পর্যন্ত ফেরিবিহীন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। যা এই সরকারের একটি নতুন মাইলফলক হিসেবে ইতিহাস হয়ে থাকবে।