করোনার টিকা বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তা কাটাবে বলেই সবার প্রত্যাশা। বিশ্বব্যাপী চাঙা শেয়ারবাজার আশা বাড়াচ্ছে। তবে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ঘটলেও বৈষম্য আপাতত স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। নতুন বছর হোক উত্তরণের বছর।
অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রেই পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে দুই বছর আগে, আর মাথাপিছু জিডিপিতে ছাড়িয়েছে তিন বছর আগে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ তথ্য বলছে, বাংলাদেশের পাকিস্তানের ছাড়িয়ে যাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনটি ঘটবে নতুন বছরে, ২০২১। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি শক্তিশালী, সেটি আসলে বলা যাবে এই নতুন বছরে। কেবল তা–ই নয়, এরপর থেকেই বাংলাদেশ ক্রমেই এগিয়ে যাবে, পিছিয়ে পড়তে থাকবে পাকিস্তান।
খবরের উৎস
কোয়ার্টজ ডটকম নিউইয়র্কভিত্তিক একটি জনপ্রিয় বিজনেস পোর্টাল। অন্য সব সংবাদমাধ্যমের মতো তারাও ২০২১ সালের নানা ধরনের প্রাক্কলন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ রকম এক প্রতিবেদনে কোয়ার্টজ বলেছে, ২০২১ সালের বৈশ্বিক জিডিপি এশিয়ার দিকেই ঘুরে থাকবে। মূলত চীন, ভারত ও মালয়েশিয়ার মতো এশিয়ার উঠতি ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি হবে ৮ শতাংশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও জাপানের মতো উন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে অগ্রসরমাণ এশিয়ার অন্যতম প্রতিনিধিত্বশীল দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। এটি বিশ্বের একমাত্র দেশ, ২০২০ এবং ২০২১—এই বছরেই যাদের প্রবৃদ্ধি হবে ২ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে মনে করা হচ্ছে, মাথাপিছু জিডিপিতে এবার বাংলাদেশ সেই পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাবে, যে দেশের কাছ থেকে আলাদা হতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল। আর এটাই হবে পরিসংখ্যানগত ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ২০২১ সালের ৫টি বড় ঘটনার একটি।
কোয়ার্টজ আর কোনো পরিসংখ্যান না দিলেও একটি লেখচিত্র প্রকাশ করেছে। সুতরাং বিস্তারিত তথ্যের সন্ধানে যেতে হলো আইএমএফের ওয়েবসাইটে। আইএমএফ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রকাশ করেছে গত অক্টোবরে। তবে বিস্তারিত পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে অতি সম্প্রতি।
আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ মূলত ছাড়িয়ে যাবে ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) তৈরি মাথাপিছু জিডিপিতে। দেখা যাচ্ছে, ১৯৮১ সালে বাংলাদেশের মোট জিডিপি ছিল ২২ দশমিক ৩৫৩ বিলিয়ন ডলার। আর মাথাপিছু জিডিপি ছিল ২৬৩ দশমিক ৭০৭ ডলার। অন্যদিকে পিপিপির ভিত্তিতে জিডিপি ছিল ৪৭ দশমিক ১০৫ বিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু পিপিপি জিডিপি ছিল ৫৫৫ দশমিক ৭১৮ ডলার।
এবার দেখা যাক পাকিস্তান পরিস্থিতি। ১৯৮১ সালে দেশটির জিডিপি ছিল ৩০ দশমিক ৯৩৮ বিলিয়ন ডলার, মাথাপিছু আয় ৩৮৪ দশমিক ৯০২ ডলার, পিপিপির ভিত্তিতে জিডিপি ৮১ দশমিক ৬৬৮ বিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু পিপিপি জিডিপি ৯৮৬ দশমিক ৮৫৩ ডলার।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পরের ৩০ বছর অনেক সূচকেই পাকিস্তানের অবস্থান ছিল বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণ। এরপর থেকে ব্যবধান ক্রমেই কমিয়ে আনে বাংলাদেশ। এর মধ্যে মোট জিডিপিতে প্রথম পাকিস্তান পিছিয়ে পড়ে ২০১৯ সালে আর মাথাপিছু জিডিপিতে পিছিয়ে পড়ে ২০১৮ সালে। সেখান থেকে আর এগিয়ে যেতে পারেনি দেশটি।
তবে মাথাপিছু পিপিপি জিডিপিতে ২০১৯ সালে পাকিস্তান একবার সামান্য পিছিয়ে পড়লেও পরের বছরেই আবার এগিয়ে যায়। আইএমএফ বলছে, ২০২১ সালে পাকিস্তান আবার পিছিয়ে পড়তে পাচ্ছে, আর তারা আপাতত বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যেতে পারছে না। অন্তত ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রাক্কলন তা–ই বলছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে পিপিপিতে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ৫ হাজার ৭৫২ দশমিক ২৩৯ ডলার, আর পাকিস্তানের হবে ৫ হাজার ২২৯ দশমিক ৯২৫ ডলার।
পিপিপিতে মাথাপিছু জিডিপি
এখানে বলে রাখা ভালো, দক্ষিণ এশিয়ায় এত দিন পিপিপিতে বাংলাদেশ ছিল কেবল নেপাল ও আফগানিস্তানের ওপরে। এখন বাংলাদেশের নিচে পাকিস্তানও থাকবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালে। সে সময় পাকিস্তানও ছিল অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। তবে তিন বছর ধরে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাওয়া শুরু করে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৫০ বছরে, ২০২১ সালে সেই এগিয়ে যাওয়াই নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে।
পিপিপি কেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
মাথাপিছু জিডিপি দিয়ে একটি দেশের প্রকৃত অবস্থা কখনোই বুঝতে পারা যাবে না। মোট জিডিপিকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলেই এটা পাওয়া যায়। এর বড় সমস্যা হচ্ছে এর বণ্টন। কারও আয় হয়তো অনেক বেশি, অন্যরা কোনোরকমে মৌলিক চাহিদা মেটাচ্ছেন। ফলে আয়ের বৈষম্য বেশি হলে মাথাপিছু আয় দিয়ে ভালো–মন্দ বিবেচনা করা যায় না।
একটি দেশের নাগরিকেরা আসলেই কতটুকু সম্পদশালী, সেটা বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো তাদের ক্রয়ক্ষমতা কতটুকু তা নির্ধারণ করা। অর্থাৎ যে অর্থ আয় করে, তা দিয়ে সে কী কী কিনতে পারে। একটি দেশের কোনো পণ্যের দর অন্য দেশের সঙ্গে মিলবে না। এ কারণেই বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকে তুলনার জন্য ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির (পিপিপি) ভিত্তিতে জিডিপির আকার হিসাব করা হয়। মূলত একটি দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানকে তুলনীয় করার জন্য নমিনাল জিডিপিকে ‘পিপিপি ডলারে জিডিপি’তে রূপান্তরিত করা হয়। সেই মাথাপিছু পিপিপি জিডিপিতেই পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সেই তথ্য
বিদায় নেওয়া ২০২০ সালের অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এটিও ছিল আইএমএফের প্রাক্কলন। ভারতে এ নিয়ে অর্থনীতি ও রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। আইএমএফের প্রাক্কলন ছিল ২০২০ পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার, আর ভারতের হবে ১ হাজার ৮৭৭ ডলার। এই প্রাক্কলনের বড় কারণ ছিল ওই বছরে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক বা (-) ১০ দশমিক ৩ শতাংশ, আর বাংলাদেশের ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের এই অর্জন আপাতত একটি বছরের জন্যই। কারণ, আইএমএফেরই এখনকার প্রাক্কলন হচ্ছে, ২০২১ সালে ভারতের প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ, আর বাংলাদেশের ৪ শতাংশ। এতে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ৩০ ডলার, বাংলাদেশের হবে ১ হাজার ৯৯০ ডলার। আর আগামী ২০২৫ পর্যন্ত যে প্রাক্কলন তাতে দেখা যাচ্ছে, ভারত আরও এগিয়ে যাবে। যদিও গত এক দশকে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে ব্যবধান অনেক কমিয়ে এনেছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে পিপিপির ভিত্তিতে ভারতের জিডিপি হবে ৯ হাজার ৬৫৪ দশমিক ২৪৭ বিলিয়ন ডলার, আর বাংলাদেশের হবে ৯৭৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পিপিপিতে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ৬ হাজার ৯১৭ দশমিক ৭৬৩ ডলার, সেখান বাংলাদেশের ৫ হাজার ৭৫২ দশমিক ২৩৯ ডলার।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালে। সে সময় পাকিস্তানও ছিল অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। তবে তিন বছর ধরে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাওয়া শুরু করে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৫০ বছরে, ২০২১ সালে সেই এগিয়ে যাওয়াই নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে, এরপর থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে আরও দ্রুতগতিতে।