পাকিস্তানে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে ফেরার আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম লন্ডন সফরের ঐতিহাসিক দিনটি স্মরণ করল যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাই কমিশন। এ উপলক্ষে শনিবার হাই কমিশনের পক্ষ থেকে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যাতে ব্রিটিশ সরকারের মিনিস্টার ও বিরোধী দলীয় নেতাদের পাশাপাশি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও হাউজ অব লর্ডসের কয়েকজন সদস্য, রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা অংশ নেন।
‘বঙ্গবন্ধু ও ব্রিটেন: ঐতিহাসিক ৮ জানুয়ারি’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে তাদের কথায় উঠে আসে ১৯৭০ এর দশকের ব্রিটিশ সরকার এবং কনজারভেটিভ ও লেবার পার্টির নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ বন্ধুত্বের কথা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার আগে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডনে যাত্রাবিরতি করেন এবং তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথ এবং বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা স্যার হ্যারল্ড উইলসনের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন।
“সেটা ছিল ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ সরকার এবং বিরোধী দলে থাকা লেবার পার্টির সঙ্গে তার অনন্য বন্ধুত্বের এবং ব্রিটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য তার অকুণ্ঠ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।” পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, স্যার এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে ৮ জানুয়ারির সেই সরকারি বৈঠকেই বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য দৃঢ় বন্ধুত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, যার ব্যাপ্তি পরের ৫০ বছরে দ্রুত বেড়েছে। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর সেই সফরই যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতির পথ খুলে দিয়েছিল। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। ওই রাতেই বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর শুরু হয় বর্বর হামলা। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান বঙ্গবন্ধু। তার ডাকে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তি সংগ্রামে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বিশ্ব জনমতের চাপে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। মুক্তির পর তিনি লন্ডন যান। সেখান থেকে ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর একটি বিমানে করে ১০ জানুয়ারি দিল্লি হয়ে ঢাকা পৌঁছান।
যুক্তরাজ্যের ফরেইন অ্যন্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের দক্ষিণ এশিয়া ও কমনওয়েলথ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী লর্ড তারিক আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু কেবল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য অনুপ্রেরণা নন, স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের জন্য যারা লড়াই করে চলেছে, তাদের জন্যও তিনি আলোকবর্তিকা। বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে অংশীদারিত্ব আর গভীর বন্ধুত্বের যে সম্পর্ক গত ৫০ বছর ধরে অটুট রয়েছে, ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারির সেই লন্ডন সফরেই বঙ্গবন্ধুর হাত দিয়ে তার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন লর্ড আহমেদ। তিনি বলেন, একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার যে দর্শন নিয়ে বঙ্গবন্ধু কাজ করে গেছেন, তা অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে বাংলাদেশের মানুষ শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে, যুক্তরাজ্য তাদের পাশে থাকবে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় নেতা এবং লেবার পার্টির নেতা স্যার কিয়ের স্টারমার বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক, যিনি তার দেশের মানুষের নাগরিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করতে গিয়ে ১৪ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন, যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগে বঙ্গবন্ধুর সেই লন্ডন সফরে লেবার নেতা হ্যারল্ড উইলসনের (পরে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন) সঙ্গে তার বৈঠকের কথাও অনুষ্ঠানে স্মরণ করেন স্টারমার। তিনি বলেন, ন্যায়বিচার আর সাম্যের প্রতি একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন দুই নেতা, আর সে কারণে তাদের মধ্যে এক বিরল বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তাদের সেই বন্ধুত্ব বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মানুষের সম্পর্ককে আরও মজবুত করেছে।
অনুষ্ঠানের সভাপতি লন্ডনে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম সূচনা বক্তব্যে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সেই সফরে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে তার বৈঠকটি ছিল সরকারি বৈঠক। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবেই তার সঙ্গে সেই বৈঠক করেন তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথ। কার্যত সেটা ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাজ্যের তখনকার কনজারভেটিভ সরকারের কূটনৈতিক স্বীকৃতি। ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটি বরাবরই বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং সমর্থনের প্রকাশ ঘটিয়ে গেছে, সেজন্য তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান বাংলাদেশের হাই কমিশনার। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের লেখা একটি চিঠির কথাও সাঈদা মুনা তাসনিম অনুষ্ঠানে বলেন। গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার যে দর্শন বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেছেন, তা স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী ছড়িয়ে ভবিষ্যতেও বাংলাদেশকে পথ দেখিয়ে যাবে বলে ওই চিঠিতে আশা প্রকাশ করেছেন জনসন।
অন্যদের মধ্যে ওয়েলসের ফার্স্ট মিনিস্টার মার্ক ড্রেকফোর্ড, কনজারভেটিভ পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান নিকি এইকেন, শ্যাডো সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ফরেইন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অ্যাফেয়ার্স লিসা নন্দী, ব্রিটিশ এমপি জয় মরিসে, সীমা মালহোত্রা, লর্ড বিলিমোরা, লর্ড হওয়েল, লর্ড রামি রেঞ্জার, যুক্তরাজ্যে ভারতের হাই কমিশনার গায়ত্রী ইসার কাউর, মানবাধিকার আইনজীবী শেরি ব্লেয়ার, বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দীন আহমেদ, বিবিসির সাবেক সাংবাদিক উইলিয়াম ক্রাউলি এবং যুক্তরাজ্য ও আয়রল্যান্ড প্রবাসী কয়েকশ বাংলাদেশি অংশ নেন এই অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘বঙ্গবন্ধু অ্যান্ড ব্রিটেন: এ স্পেশাল রিলেশনশিপ’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়। এরপর ছিল রাজরূপা চৌধুরীর সারদ বাদন এবং সাদিয়া ইসলাম মৌ ও তার দলের নৃত্যে বঙ্গবন্ধুর বন্দনা। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ও লর্ড তারিক আহমেদ বাংলাদেশ হাই কমিশনে বঙ্গবন্ধু লাইব্রেরির উদ্বোধন করেন। হাই কমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ হাই কমিশনের এই ভবনটি কেনেন, যা ছিল দেশের বাইরে বাংলাদেশের প্রথম কূটনৈতিক সম্পত্তি। “হাই কমিশনের কনফারেন্স রুমের নাম বঙ্গবন্ধু লাইব্রেরি রাখতে পেরে আমরা গর্বিত।… যারাই বঙ্গবন্ধুর ওপর গবেষণা করতে চান, তাদের জন্য এ লাইব্রেরি উন্মুক্ত থাকবে।”