কেলেঙ্কারির জেরে নেদারল্যান্ডসে সরকার পতন ঘটেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট ও তাঁর মন্ত্রিসভা আজ শুক্রবার পদত্যাগ করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যেই এভাবে পুরো সরকারের পদত্যাগে নেদারল্যান্ডসে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হতে পারে।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে জানানো হয়, হাজারো অভিভাবকের বিরুদ্ধে শিশু ভাতাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ তুলেছিল নেদারল্যান্ডসের কর্তৃপক্ষ। তাঁদের অনেককেই মোটা অঙ্কের অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য করা হয়েছে, যার কারণে অনেক পরিবারই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
বিবিসি জানায়, নেদারল্যান্ডসের সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট দেশটির রাজার কাছে মন্ত্রিসভার পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর দ্য হেগ শহরে সাংবাদিকদের বলেন, নিরপরাধ অনেক মানুষকেই অপরাধীর কাতারে ফেলা হয়েছে। তাদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই দায় মন্ত্রিসভার ওপরই বর্তায়।
মার্ক রুট সাংবাদিকদের আরও বলেন, ‘আমরা সবাই একমত যে পুরো ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই সবাই মিলেই দায় নিতে হবে। এ বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছেই আজ (শুক্রবার) আমি আমার পুরো মন্ত্রিসভার পদত্যাগপত্র রাজার কাছে জমা দিয়ে এসেছি।’ তিনি জানান, মার্চের মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার আগ পর্যন্ত তিনি ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালন করবেন।
নেদারল্যান্ডসের এই নেতা আরও বলেন, আইনের শাসন হতে হবে জনগণকে রক্ষার্থে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিপর্যয় ঘটেছে। করোনাভাইরাসের মধ্যেই নেদারল্যান্ডসের এভাবে নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ার বিষয়ে মার্ক রুট বলেন, করোনার বিরুদ্ধে লড়াই চলবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের স্বার্থে কাজ করে যাবে।
তবে নেদারল্যান্ডসের অর্থমন্ত্রী এরিক ওয়েবস বলেছেন, তিনি আর সরকারে নেই। তাঁর পদত্যাগ এখন থেকেই কার্যকর হবে।
দেশটিতে গত ডিসেম্বরে সংসদীয় এক তদন্তে জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে হাজারো পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তুলে সরকারি কর্মকর্তারা সরকারি ভাতা বন্ধ করে দিয়েছেন। অনেক পরিবারকেই মোটা অঙ্কের অর্থ ফেরত দিতে বাধ্যও করা হয়েছে। সংসদীয় ওই তদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ঘটনায় অনেক পরিবারই নিঃস্ব হয়ে গেছে।
নেদারল্যান্ডসের সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে জানানো হয়, সরকারি কর্মকর্তাদের ওই অন্যায়ের শিকার হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার পরিবার। এ ছাড়া ১১ হাজার মানুষের দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকায় তাঁদের সঙ্গে কর কর্মকর্তারা বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণ করেছেন। এসব মানুষের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তুলে শিশুকল্যাণ সুবিধাসহ অন্যান্য ভাতাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
বিবিসি জানায়, এক মা জানিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তুলে কর্তৃপক্ষ ৪৮ হাজার ইউরো (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫০ লাখ টাকা) ফেরত চেয়েছিল কর্তৃপক্ষ। তিনি ভুল ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও কাজ হয়নি। উল্টো কর্তৃপক্ষ তাঁর শিশুকল্যাণ ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা বাতিল করতে শুরু করে। একপর্যায়ে তাঁর বাড়িভাড়া বকেয়া পড়ে, বাসার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি চাকরিও হারান। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ থাকায় আর কেউ তাঁকে চাকরি দেয়নি।
এক অভিভাবক একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, মন্ত্রিসভায় এমন লোক রয়েছেন, যাঁরা এমন অন্যায় ঘটতে দিয়েছেন। শুধু তা–ই নয়, তাঁরা এই অন্যায় ধামাচাপা দেওয়ারও চেষ্টা করেছেন।
এসব ঘটনায় গত মঙ্গলবার সদ্য সাবেক মন্ত্রিসভার তিন সদস্য, বিরোধীদলীয় নেতা আশেরসহ সাবেক দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগীরা। এ ঘটনায় রুটের পদত্যাগের দাবি জোরালো হচ্ছিল। বিষয়টি পার্লামেন্টে আস্থা ভোট পর্যন্ত গড়ানোর উপক্রম হয়েছিল। সংকট আরও প্রকট হয়ে ওঠে নেদারল্যান্ডসের বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা লোডউইৎক আশের গতকাল বৃহস্পতিবার পদত্যাগ করলে। তিনি রুটের আগের সরকারে সমাজকল্যাণমন্ত্রী ছিলেন। এরপরই রুটের পুরো মন্ত্রিসভার পদত্যাগের ঘোষণাটি এল।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর নেতাদের মধ্যে মার্ক রুট সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে টানা দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ২০১০ সাল থেকে নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। দেশটিতে এত দিন রুটের নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় ছিল।
তবে এই দফায় পদত্যাগ করলেও সাম্প্রতিকতম জনমত জরিপগুলো বলছে, মার্চের নির্বাচনে মার্ক রুটই আবার ক্ষমতায় আসতে পারেন। আর তা হলে ২০১০ সালের পর টানা চতুর্থ দফায় তিনি নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী হবেন।
নেদারল্যান্ডসে পুরো সরকারের পদত্যাগ করার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০০২ সালে একবার দেশটির পুরো সরকার পদত্যাগ করেছিল। ওই বছর সাত বছর আগে বসনিয়া যুদ্ধের সময় স্রেব্রেনিৎসায় মুসলিম গণহত্যার ঘটনা প্রতিরোধে নেদারল্যান্ডসের মন্ত্রিসভা ও সেনাবাহিনীর ব্যর্থতার জন্য সমালোচনা করে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপরই পদত্যাগের ঘোষণাটি আসে।