বছরের পর বছর লোকসানের ঘুরপাকে ছিল রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এই সংস্থা ঘিরে গড়ে ওঠে দুর্নীতিবাজ একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারা ছিল অপ্রতিরোধ্য। যে কারণে লোকসান ছাপিয়ে লাভের মুখ দেখা ছিল অকল্পনীয়। দীর্ঘদিন পর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় বিমানে ফিরে আসে স্বচ্ছতা। গত দুই বছরে টিকিট ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি ও দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় দেড় যুগ পর লাভের মুখ দেখতে থাকে সংস্থাটি। প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন হয়। একই সঙ্গে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ এবং অন্যান্য বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্প জোরেশোরে শুরু হয়। পর্যটন সেবায়ও সাফল্য ফিরে আসে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের দুই বছরে অনন্য উচ্চতায় ফিরেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। সাফল্য এসেছে আকাশপথে বিমান পরিবহনের মান, বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনা ও পর্যটন সেবায়। কার্গো পরিবহনের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় প্রথমবারের মতো আয় বেড়েছে রাষ্ট্রীয় এ বিমান সংস্থার; লোকসান থেকে ফিরেছে মুনাফায়। এ লক্ষ্যে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে ছিল বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। বিমানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চূড়ান্তভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সৈয়দপুর, রাজশাহী, যশোর ও ঢাকায় বিমানবন্দরে নতুন অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল সম্প্রসারণও করা হয়েছে।
করোনাকালেও উন্নয়ন কার্যক্রমের চাকা সচল থেকেছে বিমানের। বিশেষ করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প (প্রথম পর্যায় থার্ড টার্মিনাল-২,৩০,০০০ বর্গমিটার আয়তন) গ্রহণ ও বাস্তবায়ন চলমান ছিল। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সক্ষমতা বৃদ্ধি, কার্গো অ্যাপ্রোন সম্প্রসারণ, এভিয়েশন হ্যাঙ্গার নির্মাণ এবং টার্মিনাল ভবন-১ ও ২-এর নবরূপায়ণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন সম্প্রসারণ, এক্সপোর্ট/ইমপোর্ট টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ, অনুমোদন ও কাজ শুরু এবং বিদ্যমান রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ে শক্তিশালী হয়েছে। এখানে ৭৭৭ বিমান ওঠানামা করতে পারবে। কক্সবাজার বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, রানওয়ে সম্প্রসারণ করে ছয় হাজার ৬৬৭ ফুট থেকে বাড়িয়ে ৯ হাজার ফুটে উন্নীত করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তর এবং নতুন অভ্যন্তরীণ প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবন নির্মাণ চলছে। এ বিমানবন্দরে রাত্রিকালীন বিমান উড্ডয়নের জন্য আইএলএস সংস্থাপনের কাজ চলছে। আগামী মাস থেকে এখানে রাতেও বিমান উড্ডয়ন করতে পারবে।
এ ছাড়া বিমানের টিকিট ক্রয়, লোকসান ও বিমানকে ঘিরে গড়ে ওঠা দুর্নীতিবাজ শক্তিশালী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় ফিরে এসেছে স্বচ্ছতা। করোনার আগে দীর্ঘদিনের লোকসান কাটিয়ে বিমান সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছে। গত বছরের মার্চে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে মো. মহিবুল হক সচিবের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণায় বিমানের দীর্ঘদিনের শক্তিশালী সিন্ডিকেট ভেঙে বিমানকে লাভজনক ও সিভিল এভিয়েশনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। বিমানের পুঞ্জীভূত টিকিটিং দুর্নীতিও বন্ধ করেছেন তিনি। বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটায় দুর্নীতি অনেকাংশে রোধ করাও সহজ হয়। আকাশপথে যাত্রী পরিবহনে বিমানের শৃঙ্খলা ও সেবার মানও বেড়েছে। ৫ জানুয়ারি দীর্ঘ ৩৬ বছরের চাকরিজীবনের ইতি টেনেছেন মহিবুল হক। প্রশাসনের সপ্তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা সচিব থেকে সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতি পান। নিয়মিত চাকরির মেয়াদ শেষে সর্বশেষ তিনি বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে এক বছরের চুক্তিতে কর্মরত ছিলেন। সমকালকে তিনি বলেন, বিমান পরিবহনে ও দেশের
বিমানবন্দরগুলোর ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। লোকসানের অভিশাপ ঘুচিয়ে প্রথমবারের মতো লাভের মুখ দেখেছে বিমান। পর্যটন সেবায় নেওয়া হয়েছে মহাপরিকল্পনা। ইতোমধ্যে সাফল্য এসেছে। আর্থিকভাবে ভেঙে পড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টিকিটিং, কার্গো হ্যান্ডলিং, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, ইঞ্জিনিয়ারিং মেইনটেন্যান্স, জিডিএস ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত করে অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত করা হয়। তিনি বলেন, দুর্নীতিতে যুক্ত সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে বিমানকে জবাবদিহিমূলক ও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হয়েছে। বিমানের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদে সরকারের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ করে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শৃঙ্খলায় আনা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৫৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে। বিমানের লন্ডন শাখার অনিয়ম তদন্তসহ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিদেশের অন্যান্য শাখায় যোগ্য কর্মকর্তা নিয়োগ এবং কার্যক্রম স্বচ্ছ করা হয়েছে।
সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮-এ দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয় সরকার। এ লক্ষ্যে প্রায় এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীনদের পুনর্বাসনে জমি অধিগ্রহণ করা হয়। সৈয়দপুর, রাজশাহী, যশোর ও ঢাকায় নতুন অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের সম্প্রসারণও হয়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন অনিয়ম চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিয়েছে মন্ত্রণালয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সেবা উন্নতকরণ এবং আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। আইকাওর নিরাপত্তা সনদপ্রাপ্তি, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধির জন্য ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা সহজ করা, আগমনী যাত্রীদের ব্যাগেজ ২০-৪০ মিনিটের মধ্যে পাওয়া নিশ্চিত করাসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মন্ট্রিল কনভেনশনকে অনুসমর্থন করে আকাশপথে পরিবহন (মন্ট্রিল কনভেনশন) আইন-২০২০ অনুমোদনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিনোদন, গবেষণা কাজ, প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারে ড্রোন উড্ডয়ন নিশ্চিতকরণের জন্য ড্রোন নিবন্ধন ও উড্ডয়ন নীতিমালা-২০২০, অনির্ধারিত রুটে ফ্লাইট পরিচালনা-সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১৯ প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বিমান চলাচল-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে উভয় দেশ। বিমানের নিজস্ব সম্পত্তি সংরক্ষণের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বিমানের উড়োজাহাজের মাধ্যমে হজযাত্রীদের যথাসময়ে, নিরাপদে এবং নির্বিঘ্ন যাতায়াত নিশ্চিত করা হয়েছে।