একটি কয়েনকে ঘিরে কোটি টাকা খুইয়েছেন ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তাসহ অনেকে। সম্প্রতি ওই কয়েনের ঘোরে এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার পেনশনের ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা তুলে দিয়েছেন প্রতারকদের হাতে। আরেক কর্মকর্তা খুইয়েছেন ৮৪ লাখ টাকা। স্বনামধন্য এক ব্যবসায়ী দিয়েছেন প্রায় ২ কোটি টাকা!
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কোটি ডলার লাভের আশায় সর্বস্বান্ত হওয়ার আগে কেউ প্রতারণার বিষয়টি বুঝতেই পারেনি।
বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর ধানমণ্ডির পিবিআই সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।
ডিআইজি বলেন, গত ডিসেম্বরে আনন্দ গ্রুপের এক শীর্ষ কর্মকর্তা এই প্রতারকদের হাতে নগদ দেড় কোটি টাকা তুলে দেন। আরও টাকা দেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে প্রতারণার বিষয়টি ধারণা করেন তিনি। পরে এ বিষয়ে ঝিনাইদহ সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার তদন্তে একটি কয়েন ঘিরে মহাপ্রতারণার তথ্য জানতে পারে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
তদন্তের ধারাবাহিকতায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- আক্তারুজ্জামান, সালাম, মনিরুজ্জামান কামরুল ওরফে জামান, আবু তাহের জবা ও শফিকুল ইসলাম স্বপন। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত দুটি কাঠের কয়েন, নগদ ২ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ও বিভিন্ন উপকরণ জব্দ করা হয়।
পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এই কাঠের কয়েনের কী এক তেলেসমাতি! টাকা না দিতে পারলে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে সবার। যেন প্রতারিত হবেন জেনেও টাকা দিচ্ছেন সবাই।
আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. বারীর প্রতারিত হওয়ার বিষয়ে পিবিআই জানায়, জামান নিজেকে বড় ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিতেন। দেশে বিদেশে অনেক ব্যবসা এবং স্পেন-দুবাইতে নিয়মিত যাতায়াত বলে জানান। আদতে এসএসসি পাস জামান আগে নিজ বাড়িতে পেয়ারা চাষ করতেন।
বছরখানেক আগে জামানের সঙ্গে আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. বারীর পরিচয়। বিশ্বাস স্থাপনের পর প্রতারক জামান তাকে জানায়, সালাম নামে একজনের কাছে একটি কয়েন আছে। কয়েনটি গবেষণার কাজে লাগে। নাসার কাছে কয়েনটি চড়া দামে বিক্রি করা যায়। একজন আমেরিকান ক্রেতাও আছে যিনি কয়েনটি কিনতে আগ্রহী।
কিন্তু নাসা পর্যন্ত এই কয়েন কেনাবেচায় মিলিয়ন ডলার লেনদেনের প্রয়োজন। তাই তিনি আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যানের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে চান। এজন্য মোটা অঙ্কের কমিশন আছে বলেও জানায় জামান।
আরেক প্রতারক আক্তারুজ্জামান থাকতেন সীমান্ত এলাকায়। তার কাজ বিক্রেতা খোঁজা। ভাবখানা এমন তার, ভারতের সবাই তার নখদর্পণে। আদতে এইচএসসি পাস করে ঝিনাইদহের একটা বাড়িতে কেয়ারটেকারের চাকরি করতেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ৯ ডিসেম্বর আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যানকে চুয়াডাঙ্গায় নিয়ে ‘মহা মূল্যবান’ সেই কয়েন দেখায় প্রতারকরা। তার সামনেই বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে কয়েনটি পরীক্ষা করার নাটক করা হয়। একপর্যায়ে কয়েনের ‘পাসওয়ার্ড’ নিতে ভারতেও ফোন করে ওরা। কথা বলে হিন্দিতে। মোটকথা, বিশ্বাস স্থাপনের জন্য যতদূর সম্ভব নাটক সাজায় তারা।
একপর্যায়ে ফোনে কয়েনের দাম ঠিক হয় ১০ কোটি টাকা। এ সময় ক্রেতা জামান তাৎক্ষণিক সাড়ে আট কোটি টাকার চেক দেন। কমিশনের প্রলোভনে বাকি দেড় কোটি টাকা নগদ দিয়ে দেন আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান। কিছুদিন পর প্রতারকরা যখন তার কাছে ‘আসল কয়েন’ বিক্রির কথা বলে আবার টাকা চায়, তখন বিষয়টি টের পেয়ে আইনের আশ্রয় নেন তিনি।
পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, চট্টগ্রামের পিএইচপি গ্রুপের এক বড় ব্যবসায়ীও এই কয়েনের প্রলোভনে ২ কোটি টাকা দিয়েছেন। আরো টাকা দেবে বুঝতে পেরে তাকে চট্টগ্রামে আটকে রাখেন তার জামাতা।
‘কোনওভাবেই শ্বশুরকে আটকাতে না পেরে ওই জামাতা আমাদের বিষয়টি জানান। পরে আমরা বিমানবন্দর থেকে ওই ব্যবসায়ীকে অফিসে নিয়ে আসি। তিনি প্রতারকদের টাকা দেওয়ার জন্য এতই উদগ্রীব ছিলেন যে, বাসায় যেতে পারলেই আবার ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে আসবেন।’ জানালেন পিবিআই প্রধান।
সূত্রঃবাংলা ট্রিবিউন