ডেস্ক নিউজ
বাংলাদেশের চা-প্রেমীরা এত দিন পরিচিত ছিলেন ‘ব্ল্যাক’ ও ‘গ্রিন’ টির সঙ্গে। হবিগঞ্জের বৃন্দাবন বাগান এবার চা-প্রেমীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ভিন্ন রং ও স্বাদের চায়ের আরও দুটি জাতের সঙ্গে। দীর্ঘদিনের গবেষণা কাজে লাগিয়ে এবার বাগানটিতে উৎপাদিত হয়েছে ‘হোয়াইট’ ও ‘ইয়েলো’ টি। নতুন এ দুটি জাত চা শিল্পকে নতুন সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। ‘ব্ল্যাক’ ও ‘গ্রিন’ টির কয়েক গুণ বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছে নতুন জাতের এ দুই চায়ে। তবে চা বাগানসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া শুরুতে বাণিজ্যিকভাবে এ চা উৎপাদন সম্ভব হবে না। তবে সফলভাবে এ চা উৎপাদন করা গেলে বিদেশে এর ব্যাপক বাজার ও চাহিদা রয়েছে। রপ্তানির মাধ্যমে আয় করা যাবে বৈদেশিক মুদ্রা।
চা বাগানসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দেশের অভ্যন্তরে দিন দিন চায়ের চাহিদা বাড়ছে। একই সঙ্গে মানুষ ‘ব্ল্যাক টি’র পাশাপাশি ভিন্ন স্বাদের চায়ের দিকে ঝুঁকছে। ভোক্তাদের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে হবিগঞ্জের বৃন্দাবন বাগানে এ বছর উৎপাদন করা হয় ‘ইয়েলো টি’ বা ‘হলুদ চা’। বাংলাদেশে এ চা খুব বেশি পরিচিত না হলেও বিদেশে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। বৃন্দাবন চা বাগানে উৎপাদিত ‘ইয়েলো টি’ ১৫ মার্চ চট্টগ্রাম চা নিলাম কেন্দ্রে অকশনে তোলে পূর্ব বাংলা ব্রোকার্স। পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদিত চায়ের পুরো লটটি প্রতি কেজি ৮ হাজার ৩০০ টাকা দামে কিনে নেয় শ্রীমঙ্গলের গুপ্ত টি হাউস। ১৮ মার্চ শ্রীমঙ্গল নিলাম কেন্দ্রে একই বাগানে উৎপাদিত ‘ইয়েলো টি’ বিক্রি হয় ১২ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে। দেশের ১৬০ বছরের চায়ের ইতিহাসে এটিই চায়ের সর্বোচ্চ দাম বলে মন্তব্য করেছেন শ্রীমঙ্গল টি ব্রোকার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহম্মদ। ২০১৮ সালে শ্রীমঙ্গল নিলাম কেন্দ্রের প্রথম নিলামে ইস্পাহানির বিশেষ মানের চা বিক্রি হয়েছিল ১১ হাজার টাকা কেজি দরে।
বৃন্দাবন চা বাগানের ব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন খান গণমাধ্যমকে জানান, চা-প্রেমীরা সব সময় ভিন্ন স্বাদ চান। স্বাস্থ্যসচেতনরা ‘ব্ল্যাক টি’র পরিবর্তে ‘গ্রিন টি’, ‘ইয়েলো টি’ ও ‘হোয়াইট টি’ বেশি পছন্দ করেন। ভোক্তাদের চাহিদার বিষয় চিন্তা করে পরীক্ষামূলকভাবে বাণিজ্যিকভাবে ‘ইয়েলো টি’ উৎপাদন করা হয়েছে। বাজারে এ রকম চায়ের চাহিদাও রয়েছে। তিনি আরও জানান, কোরিয়া ও চীনে ‘ইয়েলো টি’ উৎপাদিত হয়। তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশেষ জাতের এ চা উৎপাদন করল। আর বৃন্দাবন চা বাগান দেশের মধ্যে প্রথম এ চা উৎপাদন করেছে। বিশে^ চায়ের বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে নতুন স্বাদ ও গন্ধের চা উৎপাদনের বিকল্প নেই। এ চিন্তা থেকেই এ চা উৎপাদন করা হয়েছে। বাগানে উৎপাদিত ‘ইয়েলো টি’ আমেরিকাসহ উন্নত বিশে^র দেশগুলোয় রপ্তানির পরিকল্পনার কথাও জানান নাসির উদ্দিন খান। ইয়েলো টি ক্যান্সার প্রতিরোধক এবং হার্টের রোগ দূর করতে ভালো ভূমিকা রাখে বলেও মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। হার্টে ব্লক থাকলে এ চা নিয়মিত পানের ফলে সে ব্লক ছুটে যায় বলেও অভিমত তাদের। এদিকে ‘ইয়েলো টি’র মতো সারা দেশে সাড়া ফেলেছে ‘হোয়াইট টি’ও। বিশেষ জাতের এ চা-ও উৎপাদন হচ্ছে বৃন্দাবন চা বাগানে। ৩ ফেব্রুয়ারি শ্রীমঙ্গল নিলাম কেন্দ্রে সিলভার নিডেল গ্রেডের ‘হোয়াইট টি’ নিলামে প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ১০ টাকা দরে। বাংলাদেশ চা বোর্ডসূত্রে জানা গেছে, ‘হোয়াইট টি’ বা ‘সাদা চা’ ক্যামেলিয়া সাইনেসিস থেকে উৎপন্ন হয়। চীনে প্রথম এ চা চাষ করা হয়েছিল। অতিসম্প্রতি এটি পূর্ব নেপাল, তাইওয়ান, উত্তর থাইল্যান্ড, গল (দক্ষিণ শ্রীলঙ্কা) ও ভারতে উৎপাদন করা হচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশেও এর উৎপাদন শুরু হয়েছে।
সাদা চা ক্যামেলিয়া সাইনেসিস নামক গাছের কুঁড়ি ও পাতা থেকে তৈরি হয়। পাতা ও কুঁড়িকে সূর্যের তাপে বিবর্ণ এবং শুকানো হয়।
সাধারণ চা বা ব্ল্যাক টির চেয়ে গ্রিন টির মধ্যে চার গুণ মানবদেহের উপকারী ‘অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট’ থাকে। আর হোয়াইট টিতে গ্রিন টির চেয়েও তিন গুণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে।
‘ইয়েলো’ ও ‘হোয়াইট’ টির চাহিদা ও বাজারমূল্য বেশি হলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া দেশের বড় বাগানগুলোয় এটি উৎপাদন সম্ভব নয় বলে দাবি করেছেন বাগানসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, উন্নত জাতের এ চা উৎপাদনে খরচ বেশি। প্রক্রিয়াজাত করতে হয় ম্যানুয়েলি। তাই শুরুতে এ চা উৎপাদনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ চা সংসদ উত্তর সিলেট সার্কেলের চেয়ারম্যান নোমান হায়দার চৌধুরী জানান, সিলেটে পরীক্ষামূলকভাবে ‘ইয়েলো’ ও ‘হোয়াইট’ টি উৎপাদিত হয়েছে। দাম বেশি হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে এর চাহিদা খুব বেশি নেই। তবে বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এ রকম জাতের চা উৎপাদনে খরচ অনেক বেশি পড়ে। তাই বাগানগুলো এ রকম চা উৎপাদনে আগ্রহী হয় না।
তিনি বলেন, চা বাগান মালিকরা নিলামে চায়ের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। চা বিক্রি করে উৎপাদন খরচই বের করা সম্ভব হচ্ছে না। উৎপাদন বাড়লে চায়ের দাম আরও কমে যায়। অথচ দিন দিন বাজারে প্যাকেটজাত চায়ের দাম বেড়েই চলেছে। তাই চা শিল্প রক্ষায় নিলামে চায়ের মূল্য বাড়াতে হবে। বাগান মালিকরা লাভের মুখ দেখলে তারা নতুন জাতের চা নিয়ে আরও আগ্রহী হবেন।