ডেস্ক নিউজ
আশির দশকের শেষদিকে মাত্র গুটিকয়েক কারখানায় মেশিন নিয়ে কাজ শুরু করেন উদ্যোক্তারা। রপ্তানি করেন মাত্র ১২ হাজার ডলার মূল্যের পোশাকপণ্য। সেখান থেকে আর পেছনে ফিরতে হয়নি তৈরি পোশাকশিল্প উদ্যোক্তাদের। একের পর এক বাড়তে থাকে কারখানা ও মেশিন। বাড়তে থাকে শ্রমিক ও রপ্তানি। আজ দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৬ শতাংশ পূরণ করে তৈরি পোশাক খাত। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির মাইলফলক স্পর্শ করেছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প। শিল্পের সঙ্গে শ্রমিক যুক্ত হয়েছেন ৪০ লাখ। এর মধ্যে নারী শ্রমিকই রয়েছেন ২৫ লাখ। বিশ্বের ১৬৭টি দেশে যাচ্ছে ‘মেইড ইন বাংলাদেশের’ তৈরি পোশাক।
শিল্পোদ্যোক্তারা জানান, শ্রমিকদের নিরন্তর পরিশ্রমের ফসল আজ তৈরি পোশাক বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। জাতীয় রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশই আসে এই তৈরি পোশাক খাত থেকে। এ শিল্প খাতে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। এ শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে শুধু পিছিয়ে পড়া নারীদের ব্যাপক কর্মসস্থানই নয়, সমাজে তাদের সম্মানজনক অবস্থান তৈরির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। অর্থনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি তারা নিজের ব্যাপারেও অনেক সচেতন হচ্ছেন।
জানা গেছে, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ২০২০ সালের দ্য হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম অবস্থানে আছে। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ
জাতিসংঘের ভাষাতে ‘রোল মডেল’ হিসেবে অনুসরণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। শিশুমৃত্যুহার হ্রাস, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন, জেন্ডার সমতা অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়নসহ সব লক্ষ্য পূরণেই পোশাকশিল্প নীরব সৈনিকরূপে সহায়কের ভূমিকা পালন করেছে। শুধু তাই নয়, বিগত এক দশকে সবুজ শিল্পায়নে পোশাক খাত অসাধারণ সফলতা দেখিয়েছে।
জানা গেছে, দেশে বর্তমানে লিড সার্টিফাইড গ্রীন পোশাক কারখানার সংখ্যা প্রায় ১৩৫টি। এর মধ্যে ৩৯টি প্লাটিনাম মানের। বিশ্বের প্রথম সারির ১০টি সবুজ কারখানার মধ্যে ৬টি বাংলাদেশে অবস্থিত। আরও প্রায় ৫শটি কারখানা লিড সনদের জন্য আবেদন করেছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, শ্রমিকের অধিকার, সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিছু দুর্ঘটনার মাধ্যমে দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের অভ্যন্তরীণ কিছু দুর্বলতা উন্মোচিত হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে আরএমজি সাসটেইনেবিলিটি কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ক্রেতা, শ্রমিক, সরকার এবং শিল্পোদ্যোক্তারা এক প্ল্যাটফরমে একত্রিত হয়েছেন।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক আমাদের সময়কে বলেন, ‘গো হিউম্যান, গো গ্রিন’- এ মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী এবং জাতির পিতার ১০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিজিএমইএ সরকারের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ৭টি প্রতিশ্রুতি পূরণে কাজ করে যাচ্ছে। পোশাকশিল্পের প্রাণ যে শ্রমিক ভাইবোনেরা তাদের সহায়তা করা, সেই সাথে আর্থসামাজিকভাবে উন্নত জীবন ও ভবিষ্যৎ গড়ে তোলাই এসব প্রতিশ্রুতির মূল লক্ষ্য।
তিনি জানান, বর্তমানে মোট ৭০ নারীকর্মী সংশ্লিষ্ট কারখানার সহায়তায় চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ প্রোগ্রামের অধীনে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নরত রয়েছেন। যেসব শ্রমিক ভাইবোনদের সন্তানেরা কারখানার ডে কেয়ার সেন্টারে পুরো দিন কাটায়, তাদের অনলাইন শিক্ষা প্রদানের জন্য বিজিএমইএ এবং জাগো ফাউন্ডেশন যৌথ উদ্যোগে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা শিল্পকে একটি নতুন দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করছি। প্রথাগত ব্যবসা এবং পণ্য থেকে বেরিয়ে বাজার ও পন্য বহুমুখীকরণ, সর্বোপরি শিল্পখাত বহুমুখীকরণের ওপর আমরা গুরুত্বের সাথে কাজ করছি। নিরাপত্তা এবং সবুজ শিল্পায়নের পাশাপাশি কারখানাগুলো এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করছে, সার্কুলার ফ্যাশনের ক্ষেত্রে কারখানাগুলো আরও সচেতন হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিশ্ব পোশাক বাজারে আমরা মাত্র ৬ দশমিক ৮ শতাংশ শেয়ার দখল করতে পেরেছি। অর্থাৎ প্রচ্ছন্নভাবে আমাদের সামনে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। পণ্য বহুমুখীকরণ নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনার জায়গা। বিশেষ করে উচ্চমূল্য সংযোজনকারী পণ্য তৈরিতে বিনিয়োগ এবং ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। করোনাপরবর্তী সময়ে পোশাকের খুচরা বাজারে অন্যতম আরেকটি প্রধান পরিবর্তন যেটি লক্ষণীয় তা হলো- অনলাইনভিত্তিক বিক্রির প্রসার। আমাদের জন্য পরবর্তী সুযোগের যে জায়গাগুলো আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ভার্চুয়াল বাজারে আমাদের অবস্থান সুসংহত করা, যেখানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাক রপ্তানির সুযোগসহ আমরা আমাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডের পোশাক বিক্রির সুযোগ তৈরি করতে পারি।
ড. রুবানা হক আরও বলেন, চলমান প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস আজ শুধু একটি বৈশ্বিক মহামারীই নয়, বরং দ্রুত এটি অর্থনৈতিক মহামারীতে রূপ নিচ্ছে। করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশের পোশাক খাত যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা এ শিল্পে এর আগে কখনো ঘটেনি। করোনাকালীন সময়ে কারখানাগুলো যখন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছিল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে মুহূর্তে রপ্তানিমুখী খাতে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঋণ ঘোষণা দেন, যা ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ। এই ঋণ প্রণোদনার ফলে একদিকে কারখানাগুলো যেমন শ্রমিকদের বেতন নিয়মিত প্রদান করে টিকে থাকার সুযোগ পেয়েছে। শিল্পের সব ক্রান্তিলগ্নে তিনি অভিভাবকের মতো আমাদের পাশে থেকেছেন, দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা। যার ফলে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বে¡ও আমরা টিকে থাকার সংগ্রামে শক্তি ও সাহস পেয়েছি।
সংসদ সদস্য ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক আজ বাংলাদেশের জন্য গর্ব। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের গুণগত মান এতটাই উন্নত যে ক্রেতারা একবার পোশাক নিলে অন্য দেশে যেতে যায় না। তারা আবারও আমাদের দেশের পোশাক নিতে চায়। বিশ্ববাজারে ‘মেইন ইন বাংলাদেশের’ সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। আর এসব অর্জনের পেছনের কারিগর শ্রমিক ভাই ও বোনেরা। এই অল্প সময়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশই অর্জন করেছে। রপ্তানি আয় ৩৪ বিলিয়ন ডলার।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার শিল্পবান্ধব সরকার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এ শিল্পের উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এ শিল্পের যখন যা প্রয়োজন তিনি তাই দেন।
তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে নিজ উদ্যোগে পাশে দাঁড়িয়েছেন। নানাভাবে সহায়তা করেছেন। পোশাক কারখানাসহ রপ্তানিমুখী শিল্পের কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে সরকারের প্রণোদনা তহবিল থেকে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন শিল্পমালিকদের।