ডেস্ক নিউজ
মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার আউটশাহী গ্রামের আসলাম ঢালী গত শুক্রবার সকালে ঢাকায় থাকা নাতনি আরিশার সঙ্গে ভিডিওকলে কথা বলছিলেন। এ সময় আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘আঃ এখন প্রযুক্তি সবকিছু কত সহজ করে দিয়েছে। যখন বিদেশে ছিলাম ভিডিওকল তো দূরের কথা, টেলিফোনেও কথা বলতে পারতাম না। দেশে একটা চিঠি পাঠাতেও অনেক সমস্যা হতো।’ ১৯৮৮ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে প্রবাসজীবন কাটিয়েছেন তিনি। জানালেন, শুরুর দিকে পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নিতে চিঠিই ছিল একমাত্র ভরসা। পরে বছরে দু-এক বার জেলা শহরে থাকা এক আত্মীয়ের বাসায় টেলিফোনে কথা বলার সুযোগ হতো। পাশের বলই গ্রামের আমেনা বেগমও অনেক খুশি শুধু তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধায়। ফ্রান্সপ্রবাসী দুই ছেলের পাঠানো টাকা পেয়ে যান নিজের মোবাইল ফোনেই। প্রতিদিনই ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেন ভিডিওকলে।
এ তো গেল টেলিযোগাযোগব্যবস্থার গল্প। শুধু এ খাতই নয়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে গত ৫০ বছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে দেশ। মহাকাশে বাংলাদেশ উৎক্ষেপণ করেছে নিজস্ব স্যাটেলাইট। দেশের বেসরকারি টেলিভিশনগুলো নিজ দেশের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে চালাচ্ছে নিজেদের সম্প্রচার কার্যক্রম। বেশ কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথ চলছে দেশীয় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা বাঁচিয়ে এখন আয়ও করছে। গ্লোবাল সফটওয়্যার ও অ্যাপ মার্কেটেও বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। চলতি বছরের মধ্যে এ খাত থেকে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে ব্যাংকিং-ব্যবস্থার ধরন পাল্টে দিয়েছে অনলাইন ব্যাংকিং। মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যাংককে নিয়ে গেছে ঘরে ঘরে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ সাইটে নিজেদের পেজ তৈরি করে ব্যবসা করছেন তরুণ প্রজন্মের লাখ লাখ উদ্যোক্তা। দ্রুতগতির ইন্টারনেটের সুবিধায় বড় বাজার তৈরি করেছে ই-কমার্স খাতও।
অন্যদিকে দাফতরিক কাজেও ডিজিটাল বাংলাদেশের অনেক সুবিধা ভোগ করছেন নাগরিকরা। পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, জমির পর্চাসহ অনেক সেবা এখন মিলছে অনলাইনে। এসব কাজে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্প। মোবাইলের থ্রি-জি, ফোর-জি নেটওয়ার্ক বদলে দিয়েছে ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতা। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা। দ্রুতগতির ইন্টারনেটের ফলে তরুণ প্রজন্ম ঘরে বসেই আয় করার সুযোগ পাচ্ছে। ফ্রিল্যান্সিং ঘোচাচ্ছে বেকারত্বের অভিশাপ। ইন্টারনেটের সুবিধা নিয়ে ডিজিটাল হয়েছে বিচার বিভাগও। চালু হয়েছে ভার্চুয়াল আদালতব্যবস্থা। দেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার সঙ্গে মানুষের জীবনে এর বড় প্রভাবও দেখা গেছে। বড় পরিবর্তন এসেছে উবার-পাঠাও-এর মতো রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হওয়ায়। এ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান যেমন বেড়েছে তেমনি অনেকের যাতায়াতে সুবিধাও হয়েছে। স্মার্টফোন ব্যবহারকারী বাড়ায় নতুন উদ্যোক্তাও সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন্স ইউনিয়ন ও ইউপিইউর সদস্যপদ অর্জন এবং ’৭৫-এর ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটালাইজেশনের বীজ বপন করে গেছেন। এরপর থেকে সরকারি পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশের অফলাইন ই-মেইলের মাধ্যমে প্রথম দেশে সীমিত আকারে ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৯৬ সালে দেশে প্রথম ইন্টারনেটের জন্য ভিস্যাট স্থাপন করা হয়। এর পরই ইন্টারনেটের বিস্তার লাভ করে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সর্বশেষ ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মূল ইশতেহারই ছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ও ‘ভিশন-২০২১’। ক্ষমতালাভের পরই আওয়ামী লীগ ইশতেহার বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে। ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তিতে জনগণের প্রবেশাধিকার এবং ব্যবহার বাড়াতে সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছে। যার ফলে অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ২০২০ সালে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১০ কোটি হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি এবং মোট জনসংখ্যার ৬২% ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ফোর-জি নেটওয়ার্ক পরিষেবা শুরু হয়। বর্তমানে ফাইভ-জি পরিষেবা শুরুর কাজ চলছে। ২০২০ সালের মে পর্যন্ত ইন্টারনেট মূলত দুটি সাবমেরিন ক্যাবল সিমিউই-৪ ও সিমিউই-৫ দ্বারা বাংলাদেশে সরবরাহ করা হয়। যার ব্যান্ডউইথ সরবরাহ সক্ষমতা যথাক্রমে ৩০০ জিবিপিএস ও ১৮০০ জিবিপিএস। ২০২৩ সাল নাগাদ তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া দেশে ৩৯টি হাইটেক পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। বর্তমানে সাতটি হাইটেক পার্ক বিনিয়োগের উপযুক্ত অবস্থায় রয়েছে। এসব পার্কে ১৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সাফল্য সম্পর্কে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘১৯৬৬ সালে দেশে প্রথম কম্পিউটার এলেও তা জনসাধারণের ব্যবহার-উপযোগী ছিল না। ১৯৭৫ সালের পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে দেশে সরকারি তেমন কোনো উদ্যোগও ছিল না। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার, অনলাইন ইন্টারনেট চালু করা হয়। সাধারণের নাগালে মোবাইল ফোনের সেবা পৌঁছে দিতে মনোপলি ভেঙে চারটি মোবাইল কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। ভিস্যাটের মাধ্যমে ইন্টারনেট চালুসহ যুগান্তকারী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে ডিজিটাইজেশনের বপিত বীজটিকে চারা গাছে রূপান্তর করা হয়। ২০০৯ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় তা আজ মহিরুহে রূপান্তিত হয়েছে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হয়েছে দেশ। খুব শিগগিরই তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হবে। ২০১৮ সালে ফোর-জি নেটওয়ার্ক চালুর পর পরই ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের পরীক্ষাও সম্পন্ন হয়েছে। চলতি বছরই এ সেবা চালুর পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। বঙ্গবন্ধু-২ নামে আরও একটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্যও কাজ চলছে।’
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তিতে আজ বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের সবটুকু অবদান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশবাসীকে তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এবং তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে সঠিক সময়ে সঠিক অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে বলেই মানুষ এখন সুফল ভোগ করছে। বিশেষ করে করোনাকালে আমাদের শিক্ষা, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, বাণিজ্যসহ সবকিছু অচল হয়ে যেত। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে বলেই অর্থনৈতিক চাকা সচল রয়েছে, প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। আজ ইউনিয়ন পর্যায়ে আমাদের ডাটা সেন্টার। ডিজিটাল বাংলাদেশ করার ফলেই টেলিসেন্টার, টেলিমেডিসিন, মোবাইলের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষকে টাকা পৌঁছে দেওয়া, ই-কমার্স, ভার্চুয়াল কোর্টসহ নানা কাজ করতে সক্ষম হয়েছি। সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঠিক নেতৃত্বে আমরা স্বল্পোন্নত দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেছি। আর সেগুলোর কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষ উপকৃত হয়েছে। যে কাজ আগামী ১২ বছরে করতে পারতাম, সে কাজটি গত এক বছরে হয়েছে। হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার পার্কে ৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ এসেছে করোনাকালে।’
এগিয়ে চলার হার স্পষ্ট : দেশে প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা গত এক যুগ ধরে দৃশ্যমান। ইতিমধ্যে মহাকাশে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইটসহ কয়েকটি বড় প্রাপ্তি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে অন্য রকম উচ্চতায়। বাংলাদেশ প্রযুক্তিবিশ্বে অর্জন করেছে নিজেদের একটি সম্মানজনক স্থান। সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের নাম হচ্ছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হিসেবে অগ্রযাত্রা। ২০১৪ সালে বিশ্বখ্যাত প্রথম সারির ম্যানেজমেন্ট কনসালটিং ফার্ম এ টি কারনির গ্লোবাল সার্ভিস লোকেশন ইনডেক্স বা জিএসএলআইয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো স্থান পায়। এ টি কারনির তালিকায় ৫০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩২। সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের তথ্যানুযায়ী বিভিন্ন কার্যকর উদ্যোগের ফলে কয়েক বছর ধরে তথ্যপ্রযুক্তিতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে আইটিইউ অ্যাওয়ার্ড, সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড, গার্টনার এবং এ টি কারনিসহ বেশ কিছু সম্মানজনক স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ।