ডেস্ক নিউজ
করোনা মহামারির কারণে গত বছরের লকডাউনে দুধ নিয়ে চরম দুর্দশায় পড়েছিলেন পাবনা-সিরাজগঞ্জের খামারিরা। দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনা কমিয়ে দেওয়ায় খোলা বাজারে পানির দরে দুধ বেচতে হয়েছিল তাঁদের। গত বছরের মার্চ থেকে শুরু করে টানা চার-পাঁচ মাস খামারিদের লোকসান গুনতে হয়েছে। তবে এবারের লকডাউনে দুধ বিক্রিতে উল্টো চিত্র। এবার দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের কাছে ধরনা দিয়ে ও দাম বাড়িয়েও প্রয়োজনীয় দুধ পাচ্ছে না। খামারিরা প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে খোলা বাজারে ও ছানা তৈরির কারখানায় ভালো দামে দুধ বিক্রি করে লাভের মুখ দেখছেন।
পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহর এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া উপজেলা নিয়ে গড়ে উঠেছে গরুর দুধ উৎপাদনের প্রধান এলাকা। প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এসব এলাকায় ছোট-বড় প্রায় ২৫ হাজার দুধের খামার আছে। এ ছাড়া গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতে গরু পালন করে দুধ উৎপাদন করা হয়। সব মিলিয়ে এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ লিটার গরুর দুধ হয়। এলাকার গরুর দুধের ওপর নির্ভর করে সরকারি মিল্ক ভিটা এবং বেসরকারি প্রাণ ডেইরি, আড়ং দুধ, ফার্ম ফ্রেশ, অ্যামোমিল্ক, পিউরা মিল্ক, ইছামতী ডেইরি, আফতাব ডেইরি, রংপুর ডেইরিসহ বেশ কিছু দুধ সংগ্রহকারী ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান। উৎপাদিত দুধের বেশির ভাগই এসব প্রতিষ্ঠান সংগ্রহ করে সারা দেশে বিপণন করে। এসব প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দিলে পানির দরে খোলা বাজারে দুধ বেচতে হয় খামারিদের।
কয়েকজন খামারির ভাষ্য, সরকার এবার লকডাউনের ঘোষণা দেওয়ার পর খামারিদের মধ্যে দুধ বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। তাঁরা ভেবেছিলেন, এবারও গত বছরের মতো লোকসান গুনতে হবে। তবে এবার দুধের চাহিদা না কমে উল্টো বেড়েছে। খামারিদের মতে, রোজা ও ঈদ উপলক্ষে স্থানীয় ছানা তৈরির কারখানা, হোটেল এবং খোলা বাজারে দুধের চাহিদা ও দাম ব্যাপক বেড়েছে। সারা দেশে চাহিদা বাড়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহের পরিমাণ ও দাম বাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে খামারিদের দুধ বিক্রিতে ভালো লাভ হচ্ছে।
মাহফুজা মীনা, বেড়া পৌর এলাকার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খামারি
খামারি ও দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠাগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোখাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক খামারিই গাভিগুলোকে পরিপূর্ণ খাবার দিতে পারছেন না। এতে দুধের উৎপাদন কমেছে। কেউ কেউ আবার গোখাদ্যের চড়া মূল্যের কারণে গাভির সংখ্যাও কমিয়েছেন। এ ছাড়া বছরের এই সময়ে এমনিতেই গাভির দুধ দেওয়ার ক্ষমতা কিছুটা কমে যায়।
বেড়া পৌর এলাকার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খামারি মাহফুজা মীনা বলেন, ‘আমার খামারে প্রতিদিন ২৫০ লিটার দুধ হয়। দু-তিন সপ্তাহ আগেও একটি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠানে গড়ে ৪৮ টাকা লিটার দরে ১৫০ লিটার দুধ দিতাম। এখন ওই প্রতিষ্ঠানে দুধ না দিয়ে পুরোটাই স্থানীয় হোটেল ও খোলা বাজার ৬০ থেকে ৭০ টাকা লিটার দরে বিক্রি করছি। গোখাদ্যের দাম বাড়লেও এমন দামে আমরা (খামারিরা) বেশ খুশি।’
সাঁথিয়ার বোয়াইলমারি গ্রামের খামারি রওশন আলী বলেন, ‘লকডাউন দেওয়ায় ভাবছিল্যাম এবারও বুঝি ধরা খাব। কিন্তু এখন দেখত্যাছি এমন সময়েও দুধের দাম বেশি পাতেছি।’
প্রাণ ডেইরির সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) ইফতিখারুল ইসলাম বলেন, ‘লকডাউনের আগে থেকেই পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চল থেকে আমরা চাহিদা অনুযায়ী দুধ পাচ্ছিলাম না। প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ লিটারের জায়গায় দুধ পাচ্ছিলাম ৪০ থেকে ৫০ হাজার লিটার মাত্র। এর মধ্যে আমরা দুধের দামও বেশ বাড়িয়েছি। তারপরও প্রয়োজন অনুযায়ী দুধ পাচ্ছি না বলা চলে।’
এবার লকডাউনে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এলাকার খামারিরা দুধের ভালো দাম পেয়ে খুশি। পাবনার সাঁথিয়ার আমাইকোলা গ্রাম থেকে তোলা ছবি
সাঁথিয়ার আমাইকোলা গ্রামে অবস্থিত আরেক দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান পিউরা মিল্কের মালিক আবদুর রউফ বলেন, ‘গতবারের লকডাউনের সময় অনেক খামারি দুধ ফেলে পর্যন্ত দিয়েছেন। কিন্তু এবার আমরা দুধের দাম লিটারে ৮ থেকে ১০ টাকা বাড়িয়ে ও খামারিদের কাছে ধরনা দিয়েও দুধ পাচ্ছি না। দুধের এত দাম জীবনে দেখিনি। আমার প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন কমপক্ষে ১২ হাজার লিটার দুধের চাহিদা থাকলেও কোনো দুধই পাচ্ছি না।’
এদিকে পাবনা-সিরাজগঞ্জে আছে শতাধিক ছানা তৈরির কারখানা। এসব কারখানার ছানার চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। খামারিরা লকডাউনের শুরুতে এসব কারখানায় ৪৬ থেকে ৫২ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করলেও এখন সেখানে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।
আমাইকোলা গ্রামের একটি ছানা তৈরির কারখানার ব্যবস্থাপক ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘লকডাউন নিয়্যা ভয়ে ছিল্যাম। কিন্তু এবার দুধ ও ছানা দুটারই চাহিদা বাড়িছে। এখন আমরা লিটারে ৮ থেকে ১০ টাকা দাম বাড়ায়াও প্রয়োজনীয় দুধ পাতেছি না।’