ডেস্ক নিউজ
জামালপুর সদর উপজেলার চা বিক্রেতা মোহাম্মদ হারুন। করোনার সময়ে দোকান বন্ধ থাকায় অর্ধাহারে কষ্টে কাটছিল দিন। তার স্ত্রী চম্পা জানতে পারেন ৩৩৩-এ কল করলে ত্রাণ সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে। গভীর রাতে চম্পা কল করেন। পরদিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পক্ষে তার কর্মীরা চম্পা-হারুনের বাসায় খাদ্য নিয়ে হাজির। এক কলে ত্রাণ পাওয়ায় খুশিতে আপ্লুত চম্পা। কেবল চম্পার পরিবারের খাদ্য সমস্যা নয়, পুলিশি বা আইনি সেবা, দুর্ঘটনা বা অসুস্থতায় অ্যাম্বুলেন্সসহ নানা সেবায় বিপদে পরম বন্ধু হিসেবে সামনে এসেছে জাতীয় জরুরি সেবার হটলাইন। সর্বশেষ শনিবার গভীর রাতে ৯৯৯ হটলাইনে কল পেয়ে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় এক তরুণীকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার অভিযোগে দুজনকে আটক করে পুলিশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের জাতীয় হটলাইনগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে। বিশেষ করে করোনার সময়ে বিপদে প্রিয় মানুষটিকে কাছে না পেলেও ঠিকই সাহায্য মিলছে জরুরি সেবার। ফোন করে সহজে সেবা পাওয়ায় পরম বন্ধুতে পরিণত হয়েছে এসব হটলাইন। বিশেষ করে ট্রিপল থ্রি (৩৩৩) ও ট্রিপল নাইন (৯৯৯)। ফলে দিন দিন এসব হটলাইনে কলের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে।
৩৩৩-এর টেলিসেবায় জীবনরক্ষা অনেকের : যশোরের নওয়াপাড়ার বাসায় জামিল হাসানের বাবা হঠাৎ অসুস্থ হলে তিনি ৩৩৩-এ কল করেন। টেলিহেলথ সার্ভিসের পক্ষ থেকে তাকে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি হাসপাতালে ভর্তি, অ্যাম্বুলেন্স থেকে শুরু করে যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। সেদিন জামিল হাসান হয়তো তার বাবাকে ঢাকায় ভর্তি করাতে না পারলে পিতৃহীন হয়ে যেতেন। তিনি বলেন, সেদিন আমার পাশে ৩৩৩ না থাকলে বাবাকে বাঁচাতেই পারতাম না। সম্ভাব্য করোনায় আক্রান্ত ছিলেন কাবেরী চৌধুরী। পরীক্ষা করালেও তখনও ফলাফল আসেনি। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। শুরু হয় তার শ^^াসকষ্ট। পাশে সেই সময়ে স্বামীও ছিলেন না। জরুরি সেবা ৩৩৩-এ কল দিলে চিকিৎসকের পরামর্শের পাশাপাশি তার বাসায় অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে যায়। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ৩৩৩ আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। এই উপকার ভুলবার মতো নয়।
নীলফামারীর সঙ্গীতা মিতা। তার থাইরয়েডের সমস্যার কারণে বাচ্চা গর্ভপাতের পরার্মশ দেওয়া হয়। পরে তিনি ৩৩৩-এ কল করে বিষয়টি জানালে একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেন। সেই নারী পরবর্তীতে সুস্থ ছেলে সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম হন। সঙ্গীতা বলেন, ওই বিপদের দিনে ৩৩৩-এ কল না করলে আজ আমার এই সন্তানের মুখ দেখতে পেতাম না।
জরুরি কল সেন্টার ৩৩৩-এর তথ্য মতে, ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল থেকে চলতি ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত তিন বছরে ৩৩৩ নম্বরে ২ কোটি ৮০ লাখের বেশি ফোনকল গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০২০ সালে করোনাকালীন সময়ে ত্রাণ সাহায্য চেয়ে কল এসেছে ১৮ লাখের বেশি। করোনাকালীন সময়ে স্বেচ্ছাসেবী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা দেওয়া হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ নাগরিককে। নিত্যপণ্য অথবা ওষুধ ক্রয়ের ক্ষেত্রে কল এসেছে ৭ লাখ ৬ হাজার ৯১৮টি।
৩৩৩ জাতীয় কল সেন্টারের কর্মকর্তা দিদার কিবরিয়া সময়ের আলোকে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে জনসাধারণের জীবনযাত্রাকে সহজ ও স্বাভাবিক করতে জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্য, ত্রাণসেবাসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে চলেছেন তারা।
৯৯৯-এ কলে পাওয়া যেত সেবা : জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্য মতে, গত এক বছরে ৭৭ লাখ ৫৭ হাজার ৯৩৬টি কল এসেছে এই সেবার ফোনে। করোনা বিষয়ক ঘটনাই ছিল ১৮ হাজার ৬৪০টি এবং এই সমস্যা ও সমাধান পাওয়ার জিজ্ঞাসা সম্পর্কিত কল এসেছিল ৪ লাখ ৮২ হাজার ১১৬টি। সব মিলিয়ে এই সেবায় করোনা পরিস্থিতিজনিত সেবা পেতে ৫ লাখের বেশি কল নিয়েছেন তারা।
জানা যায়, গত বছরের ৩০ জানুয়ারি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ভারতীয় নাগরিক সমীরণ দত্তের ব্যাগ থেকে পাসপোর্ট, ডলারসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চুরি হয়ে যায়। পরে তিনি ৯৯৯-এ কল করেন। এই বিষয়টি কমলাপুর জিআরপি থানা পুলিশকে জানালে তারা আশপাশে অভিযান শুরু করে। পরে পুলিশের সহায়তায় পাসপোর্ট ও ডলার ফিরে পান ওই ভারতীয় নাগরিক। একই বছরের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় এক নারীকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে একটি বাসায় নিয়ে আটক রাখা হয়। পরে ওই নারী ফোন করে ৯৯৯-এ জানালে পুলিশ ঠিকানা জেনে অভিযান চালিয়ে চারজনকে আটকের পাশাপাশি ওই তরুণীকে উদ্ধার করে। চলতি বছরের এপ্রিলে দক্ষিণখানে এক তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে সালিশ বসে। সেই খবর ৯৯৯-এ জানানোর পর পুলিশ গিয়ে সেই ধর্ষককে গ্রেফতার করে ও মেয়েটিকে হাপসাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে। ভুক্তভোগী মেয়েটির বাবা সময়ের আলেকে বলেন, স্যাররা (পুলিশ) আমার মাইয়াটার ইজ্জত বাঁচাইছে। সালিশ কইরা ঘটনাটা চাপা দিবার চাইছিল।
সর্বশেষ সম্প্রতি রাত দেড়টায় চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ থেকে এক নারী কল করে জানান, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার ২৭ নম্বর সড়কের ৭৪ নম্বর বাড়িতে তার মামাতো বোনকে আটকে রেখে খারাপ কাজ করানো হচ্ছে। সেখানে তাকে চাকরির প্রলোভনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ওই বাসায় থেকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার অভিযোগে দুই কিশোরকে আটক এবং ওই তরুণীসহ আরও দুই কিশোরীকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়। এ ঘটনার পরে মামলা দায়ের করা হয়। ডবলমুরিং থানার এসআই মাহবুব রাব্বানি অপু জানান, ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে তারা ওই বাড়িটিতে অভিযান চালিয়ে তিন কিশোরীকে উদ্ধারের পাশাপাশি দুই কিশোরকে আটক করেন।
জরুরি সেবা ৯৯৯-এর গণমাধ্যম ও গণসংযোগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার বলেন, জরুরি মুহূর্তে ও প্রয়োজনে বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ২৪ ঘণ্টা ফোন করে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স সহায়তা নেওয়া যাবে। বিপদে পড়লেই কোনো প্রকার দ্বিধা না করে ৯৯৯-এ কল করার অনুরোধ করেন তিনি।