ডেস্ক নিউজ
আগামী অর্থবছরের (২০২১-২২) বাজেটে দেশীয় শিল্পের বিকাশে ভ্যাটে (মূল্য সংযোজন কর) বড় ছাড় আসছে। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশে হোম এপ্লায়েন্স সামগ্রী এবং তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। এয়ারকন্ডিশন ও রেফ্রিজারেটর উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। কৃষি আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে কৃষি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানিতে আগাম কর প্রত্যাহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে সিগারেটে নকল-জাল ও পুনঃব্যবহৃত ব্যান্ডরোল ব্যবহার বা ব্যবহারে সহায়তা করলে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি ভ্যাট বিভাগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আর্থিক বিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলত করে ‘ভ্যাট আইন’ সংশোধন করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রগুলো জানায়, ইলেকট্রনিক্স শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ায় এ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে। এখন দেশেই বিশ্বমানের এয়ারকন্ডিশন ও রেফ্রিজারেটর উৎপাদন হচ্ছে। এমনকি বিদেশি ব্র্যান্ডও দেশে কারখানা স্থাপন করেছে এবং অনেক ব্র্যান্ড পরিকল্পনা করছে। এই দুই খাতে বিপুল বিনিয়োগের কারণে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। তাই করোনা পরিস্থিতিতে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, হোম এপ্লায়েন্স সামগ্রী উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে আগামী দুই বছরের জন্য ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সার, গ্রাইন্ডার, ইলেকট্রিক কেটলি, রাইস কুকার, মাল্টি কুকার ও প্রেসার কুকার দেশে উৎপাদন করলে উপকরণ-যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট দেওয়া লাগবে না।
এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার শিল্পের বিকাশে প্রিন্টার, টোনার কার্টিজ, ইনকজেট কার্টিজ, কম্পিউটার প্রিন্টারের যন্ত্রাংশ, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, এআইও, ডেস্কটপ, নোটবুক, নেটপ্যাড, ট্যাব, সার্ভার, কিবোর্ড, মাউস, বারকোড ও কিউআর কোড স্ক্যানার, পিসিবিএ/মাদারবোর্ড, পাওয়ার ব্যাংক, রাউটার, নেটওয়ার্ক সুইচ, মডেম, নেটওয়ার্ক ডিভাইস/হাব, স্পিকার, সাউন্ড সিস্টেম, এয়ারফোন, হেডফোন, এসএসডি/পোর্টেবল এসএসডি, হার্ডডিস্ক ড্রাইভ, পেনড্রাইভ, মাইক্রো এসডি কার্ড, ফ্ল্যাশ মেমোরি কার্ড, সিসিটিভি, মনিটর, প্রজেক্টর, প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড, ই-রাইটিং প্যাড, ইউএসবি ক্যাবল, ডিজিটাল ঘড়ি, বিভিন্ন প্রকার লোডেড পিসিবি উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।
পাশাপাশি এক হাজার ৬০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে যন্ত্রাংশ আমদানিতে আগাম কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে সেটিও বাতিল করা হচ্ছে। এছাড়া পলিপ্রোপাইলিন স্ট্যাপল ফাইবার, মোবাইল ফোন এবং স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপারের কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে।
শুধু ভারি ও আইটি শিল্প নয়, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পকেও বাজেটে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসাবে শর্তসাপেক্ষে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে প্রস্তুতকৃত যন্ত্রাংশ সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। শর্ত হচ্ছে, দেশীয় ভারি শিল্পকে যেসব যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট ও শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলো লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাত উৎপাদনের পর তা সরবরাহ করলে ভ্যাট দিতে হবে না। অবশ্য এ জন্য প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট নিবন্ধিত হতে হবে এবং রিটার্ন জমা দিতে হবে।
এ বিষয়ে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সরকার ও এনবিআর লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের দিকে তাকানোয় ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এ সুযোগ কতটুকু কাজে লাগাতে পাড়বে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ শিল্পের উপযোগী যন্ত্রাংশ তৈরি করতে হলে অধিকাংশ ব্যবসায়ীর মেশিনপত্র আপগ্রেড করতে হবে। এ জন্য প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন। সমস্যা হচ্ছে, ছোট ব্যবসায়ীদের ব্যাংক টাকা দিতে চায় না। অর্থায়ন সমস্যা সমাধান করা গেলে যন্ত্রাংশ বিদেশেও রপ্তানি সম্ভব।
আসছে বাজেটে কৃষি আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে এ খাতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানিতে আগাম কর প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে-থ্রেসার মেশিন, পাওয়ার রিপার, পাওয়ার টিলার, অপারেটেড সিডার, কম্বাইন্ড হারভেস্টর, রোটারি টিলার, উইডার (নিড়ানি) ও উইনোয়ার (ঝাড়াইকল)। পাশাপাশি স্ক্র্যাপ ভেসেল, স্টিল শিল্পের ওয়েস্ট ও স্ক্র্যাপ, ফেরো অ্যালয়, স্পঞ্জ আয়রন, পিভিসি ও পেট রেজিন উৎপাদনে ব্যবহৃত ইথাইলিন গ্লাইকল, টেরেফথালিক অ্যাসিড, ইথাইলিন/প্রোপাইলিন আমদানি এবং উপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাজু বাদাম আমদানিতে আগাম কর প্রত্যাহার হচ্ছে।
বিদ্যমান ভ্যাট আইনটি আরও ব্যবসাবান্ধব ও যুগোপযোগী করতে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাটের আগাম কর (এটি) হার কমানো হচ্ছে। ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা ও সরল সুদ দুটোতেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে। আগাম কর হার ৪ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ করা হচ্ছে। আর ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা ও সরল সুদ হার দুটোই বাণিজ্য সহায়ক করতে যৌক্তিক করা হচ্ছে। বর্তমানে ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের দ্বিগুণ জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে। আগামী বাজেটে এটি কমিয়ে ভ্যাট ফাঁকির সমপরিমাণ জরিমানার বিধান করা হচ্ছে। এছাড়া সময়মতো ভ্যাট না দিলে ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক ২ শতাংশ হারে সরল সুদের বিধান রয়েছে। এটি বাজেটে এক শতাংশ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে ভ্যাট আদায় বাড়াতে বাজেটে মনিটরিংয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। রিটার্নের সঙ্গে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আর্থিক বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান রেখে ভ্যাট আইন সংশোধন করা হচ্ছে। এ জন্য আইনে নতুন ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। বর্তমানে আর্থিক বিবরণী জমা দিতে হয় না। আইন সংশোধন করে এক বছরের আর্থিক বিবরণী পরবর্তী বছরের প্রথম ছয় মাসের (করমেয়াদ) মধ্যে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হচ্ছে।
এছাড়া রাজস্ব সুরক্ষায় জাল ও নকল ব্যান্ডরোলযুক্ত সিগারেটের বিস্তার রোধে জেল-জরিমানার বিধান রেখে আইনে নতুন ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। ফলে আগামীতে জাল বা ভুয়া বা পুনঃব্যবহৃত স্ট্যাম্প-ব্যান্ডরোল ব্যবহার করলে অথবা জাল ব্যান্ডরোল উৎপাদন, সংরক্ষণ, পরিবহণ বাজারজাত করলে এক বছরের কারাদণ্ড বা প্রদেয় করের সমপরিমাণ অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। শুধু তাই নয়, নকল ব্যান্ডরোলযুক্ত কোনো পণ্য উৎপাদন, গুদামজাতকরণ, পরিবহণ, বিপণন বা বিক্রয় করলেও একই সাজা ভোগ করতে হবে।