ডেস্ক নিউজ
এবার যোগাযোগ খাতে যুক্ত হচ্ছে বৈদ্যুতিক ট্রেন। রেলপথে গতি আনতে ও যাত্রী সুবিধার কথা চিন্তা করে পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ী এই যোগাযোগ ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল বিভাগ। পদ্মা সেতুর রেল লিঙ্ক দিয়ে শুরু হবে বৈদ্যুতিক ট্রেন। পর্যায়ক্রমে দেশের সকল রেলপথই এই প্রকল্পের আওতায় আনা হবে। রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন সাংবাদিকদের বলেন, কম খরচ এবং পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বৈদ্যুতিক ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পদ্মা সেতুর রেল লিঙ্কের পর ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু করা হবে। এখন থেকে আর পুরনো পদ্ধতির কোন রেললাইন নির্মাণ করা হবে না। নতুন লাইন নির্মাণ করলে তা বৈদ্যুতিক ট্রেনের জন্য। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করার মহাপরিকল্পনা নেয়া হবে শীঘ্রই।
ভারতবর্ষে ট্রেন নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। প্রতিবেশী ভারতে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু হয়েছে অনেক আগে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে এমন চিন্তাভাবনা থাকলেও কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এর মূল কারণ এতদিন দেশে বিদ্যুতের সঙ্কট ছিল। বর্তমান সরকারের বিগত ১২ বছরের চেষ্টায় এখন বিদ্যুত সমস্যার সমাধান হয়েছে। পারমাণবিক কেন্দ্রসহ আরও বেশ কিছু কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। এসব কেন্দ্রে বিদ্যুত উৎপাদন শুরু হলে দেশের চাহিদা পূরণ করেও সাশ্রয় হবে। বিদ্যুত উৎপাদনের কথা মাথায় রেখেই রেলসহ আর কোন্ কোন্ খাতে বিদ্যুত ব্যবহার করা যায় এই চিন্তা করা হচ্ছে।
ঢাকাসহ দেশের মধ্য-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়কপথে যোগাযোগ স্থাপনে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ প্রায় শেষের পথে। এই সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমে রেলওয়ে যোগাযোগও চালু করার কাজ চলছে। ঢাকা থেকে পদ্মা বহুমুখী সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত নতুন ব্রডগেজ রেলওয়ে ট্র্যাক নির্মাণ শুরু হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য হবে ১৬৯ কিলোমিটার। লুপ সাইডিং (লাইন বদলের জন্য) এবং ডবল লাইনসহ মোট ট্র্যাক হবে ২১৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার। নির্মাণাধীন প্রকল্পে নতুনভাবে বৈদ্যুতিক ট্রেনের প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হবে।
জানা গেছে, বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু নিয়ে ইতোমধ্যে রেল বিভাগে একটি পর্যালোচনা টিম কাজ করছে। তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বৈদ্যুতিক ট্রেন সর্বোচ্চ ওজন বহনে সক্ষম এবং পরিবেশবান্ধব। পাশাপাশি এই ট্রেনগুলোর পরিবহন ব্যয়ও কম। মাত্র চার ইউনিট বিদ্যুতে এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারবে। প্রতি ইউনিট খরচ ১০ টাকা হলে এক কিলোমিটারে খরচ হবে মাত্র ৪০ টাকা। যেখানে ডিজেল চালিত ট্রেনে প্রতি কিলোমিটার জ্বালানি খরচ হাজার টাকার বেশি। রেলওয়ে বৈদ্যুতিক ট্র্যাকশন প্রবর্তন করা হবে বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য একটি মাইলফলক। এই ট্রেন চালু হলে ভ্রমণ সময় ও অপারেশনাল ব্যয় হ্রাসের পাশাপাশি যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া শহরগুলোতে বৈদ্যুতিক ট্র্যাকশন একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে যা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বিদ্যুত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রে দুটি ইউনিটে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত মিলবে। অন্যদিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পের মূল পর্যায়ের কাজ। দুই ইউনিটের এই বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে উৎপাদন হবে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত। এসব বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে যোগ হলে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা হবে ২৪ হাজার মেগাওয়াট। ২০৩০ সাল নাগাদ ৪০ হাজার এবং ২০৪১ সাল নাগাদ ৬০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে একটি মাস্টার পরিকল্পনা তৈরি করেছে সরকার। এক সময় দেশে চাহিদার থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন বেশি হবে। বাড়তি বিদ্যুত ব্যবহারের মহাপরিকল্পনা হিসেবে সকল রুটে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। চলমান খুলনা-মোংলা ৬৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করা হবে। দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের অধিগ্রহণ প্রায় ৬৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। আর বাকি আছে ৩৫ শতাংশ। এই পথেও নতুন করে সংযোজন করা হবে বৈদ্যুতিক সিস্টেম।
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, পদ্মা সেতু রেলসংযোগে ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রামের রুটেও ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করা হবে। বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু করতে পারলে রেলপথ লাভজনক হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও পদ্মা সেতু রেলসংযোগে বৈদ্যুতিক ট্রেন চলবে। নতুন রেলপথ নির্মাণ করলেই বৈদ্যুতিক ট্রেনের প্রভিশন রাখা হবে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে ইলেকট্রিক ট্রেন চালু করার মহাপরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। এক সময় দেশে বিদ্যুতের অভাব ছিল, বার বার লোডশেডিং হতো। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশ এখন বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। শুধু তাই নয়, দেশে চাহিদার থেকে বেশি বিদ্যুত উৎপাদন হচ্ছে। সামনে বিদ্যুতের উৎপাদন আরও বাড়বে। ফলে বাড়তি বিদ্যুত আমরা রেলপথে ব্যবহার করতে পারব। নতুন রেলপথ যেগুলো নির্মিত হচ্ছে সেখানে ইলেকট্রিক সিস্টেম চালু থাকবে। পুরনো রেলপথের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
রেলপথ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পুরনো রেলপথ ঢাকা-চট্টগ্রামে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালুর জন্য সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ রেলওয়ের নারায়ণগঞ্জ হতে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন (ওভারহেড ক্যাটেনারি ও সাবস্টেশন) নির্মাণে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। চলতি সময় থেকে ২০২২ সালের আগস্ট মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং টঙ্গী-জয়দেবপুরের মধ্যে চলমান ডবল লাইন প্রকল্পটি ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন ব্যবহারের আওতায় আনা হচ্ছে। এর ফলে রেল যোগাযোগ আরও কার্যকর হবে। নারায়ণগঞ্জ দেশের অন্যতম প্রধান এবং কেন্দ্রীয় শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র। চট্টগ্রামের প্রধান সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ আমদানি-রফতানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ৩০ শতাংশ জনসংখ্যা নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করে। এছাড়া এই অঞ্চলে সহজেই বিদ্যুত পাওয়া যাবে। যে কারণে এই অঞ্চল দিয়ে চালু হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম ইলেকট্রিক ট্রেন। প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যমান নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন নির্মাণের প্রযুক্তিগত, আর্থিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত উপযোগিতা যাচাই, ওভারহেড ক্যাটেনারি, সাবস্টেশন এবং উপযুক্ত প্রযুক্তির চাহিদা নির্ধারণ এবং ভবিষ্যত কৌশল সম্পর্কে সুপারিশ দেয়া হবে। বর্তমান ও ভবিষ্যত বিদ্যুত উৎপাদন পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে প্রকল্পের জন্য বিদ্যুতের বর্তমান চাহিদা ও প্রাপ্যতা নির্ধারণ করা এবং ভবিষ্যত কৌশল নির্ধারণ করা হবে। বাংলাদেশের মতো একই প্রাকৃতিক এবং অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভারতসহ অন্যান্য দেশে গৃহীত ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যত কৌশল সম্পর্কে সুপারিশ করা হবে। ট্র্যাফিক পূর্বাভাস, লেভেল ক্রসিং গেট এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ের ওপর বিশ্লেষণ করে বিস্তারিত প্রকৌশল নক্সা প্রণয়ন করে বিস্তারিত নক্সার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হবে প্রাক্কলন ব্যয়। সমীক্ষা প্রকল্পের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ৪ এবং স্থানীয় ১৩ জন পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হবে।