ডেস্ক নিউজ
বহুল প্রতীক্ষিত ও স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ওপর রোডওয়ের শেষ স্লাব বসানোর কাজ শেষ হয়েছে গতকাল সকালে। এর মাধ্যমে পদ্মার দুই তীরের রাস্তার সংযোগ স্থাপিত হলো মূল সেতুর সঙ্গে। পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। বাঙালির কাছে পদ্মা সেতু আবেগের নাম। পদ্মার দুই তীরের লাখো মানুষ যারা নিজের শেষ আশ্রয় বাপ-দাদার কবর, ফসলি জমির মায়া ছেড়ে দিয়ে বুনেছেন স্বপ্নের জাল তাদের দুই চোখেও আজ আনন্দের অশ্রু। বিশ্বব্যাংকের অপবাদ মিথ্যা প্রমাণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে এ সেতু। প্রমাণ করেছে কোনো প্রতিশ্রুতি সুদৃঢ় হলে যে কোনো দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব। এমন এক খরস্রোতা নদীও হার মানে বাঙালির দৃঢ়তার কাছে। এ সেতু শুধু রড, সিমেন্ট ও পাথরের নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের আবেগ। চ্যালেঞ্জ জয় করার অদম্য স্পৃহা এবং আগামীতে দেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার হাতছানি। যে পদ্মার একদিন ছিল না কূলকিনারা, সামনের বছর শেষে সেই পদ্মার বুক দিয়ে ছুটবে গাড়ি, চলবে ট্রেন। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্ত এক সুতোয় গেঁথে দৃষ্টিসীমায় পূর্ণরূপে ভেসে উঠবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো।
স্বপ্নের এ সেতুর শেষ স্লাব বসানোর পর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মূল পদ্মা সেতুর ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্লাবের সব কটি স্থাপনের কাজ আজ (গতকাল) সকালে শেষ হয়েছে। এর মাধ্যমে পদ্মার দুই তীরের রাস্তার সংযোগ স্থাপিত হলো। অক্টোবরের শেষ দিকে কার্পেটিংয়ের কাজ শুরু হবে এবং ২০২২ সালের জুনের মধ্যেই পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। মন্ত্রী গতকাল সকালে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটি আয়োজিত ‘জাতির পিতার হত্যাকান্ড, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র’ শীর্ষক জাতীয় শোক দিবসের ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন। তিনি আরও জানান, মূল পদ্মা সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগতি শতকরা ৯৪.২৫ ভাগ। নদীশাসন কাজের বাস্তব অগ্রগতি শতকরা ৮৪.২৫ ভাগ। পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি শতকরা ৮৭.২৫ ভাগ। মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
পদ্মা সেতুর দুই পাড় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গতকাল সকালেই শেষ হয়েছে সেতুর ওপর রোডওয়ে স্লাব বসানোর কাজ। এতে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতুতে পূর্ণাঙ্গ রূপ পেল সড়কপথ। গাড়িতে চড়ে বা হেঁটে পার হওয়া যাবে পদ্মা। পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, গতকাল সকাল থেকে সড়কপথে সম্পূর্ণ এপার-ওপার সংযোগ হলো। এর আগে রেলওয়ে স্লাব বসানোও শেষ হয়েছে। এ ছাড়া সেতুর মাঝখান দিয়ে গ্যাসলাইন বসানোর কাজ শুরু হয়েছে পুরোদমে। জুনের আগেই সম্পূর্ণ কাজ শেষ করার মিশন নিয়ে প্রকল্পে কর্মরত দেশি-বিদেশি কয়েক হাজার মানুষ দিনরাত কাজ করছেন। ইতিমধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় এসে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি ঘোষণা দিয়েছেন আগামী জুনের যে কোনো দিন জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সেতুর শুভ উদ্বোধন করবেন। সে লক্ষ্যে সেতু প্রকল্পে কর্মরত দেশি-বিদেশি শ্রমিকরা কাজ করে চলেছেন। রোডওয়ে স্লাবের ওপর পিচ ঢালাইয়ের কাজ করে পরীক্ষা করা হয়েছে। আগামী মাসে পুরোদমে শুরু হবে পিচ ঢালাইয়ের কাজ। গেল ২০ জুন শেষ হয় দ্বিতল সেতুর রেলওয়ে স্লাব বসানোর কাজ। এখন চলছে গ্যাসলাইন বসানোর কাজ। পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে এপার-ওপার গ্যাস সংযোগের জন্য গেল সপ্তাহে গ্যাসলাইনের পাইপ স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। এসব পাইপ স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে সেতুর রেলপথের পুব পাশ দিয়ে। ৫৩১টি গ্যাস পাইপ বসানো হবে সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার অংশে। গ্যাস পাইপগুলোর দৈর্ঘ্য ১২ মিটার, ব্যাস ৭৬০ মিলিমিটার, ওজন ৫ দশমিক ৬৭ টন। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি গ্যাস পাইপ স্থাপন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের। তিনি জানান, প্রথম গ্যাস পাইপটি ৪২ ও ৪১ নম্বর পিলারের মধ্যবর্তী স্থানে বসানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় পদ্মা সেতুতে গ্যাসলাইনের পাইপ বসানোর কাজ। গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনে কাজ করছে চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। সেতুর পিলারের ওপর স্থাপন করা স্প্যানের সাপোর্টে রাখা হচ্ছে পাইপ। তারপর একটি পাইপের সঙ্গে আরেকটি পাইপ ঝালাই করে দেওয়া হচ্ছে। কাজ শেষে সেতুর ১ নম্বর পিলারে স্থাপন করা পাইপের ভিতর দিয়ে গ্যাস যাবে জাজিরা প্রান্তের ৪২ নম্বর পিলারে। মাওয়া প্রান্তের ১ নম্বর পিলার দিয়ে গ্যাস যাবে, জাজিরা প্রান্তের ৪২ নম্বর পিলার হয়ে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোয় গ্যাস সরবরাহ করা হবে। গ্যাস পাইপ স্থাপনের আগে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এরপর হলুদ রং করা হয়। গ্যাস সরবরাহ কাজের জন্য মাওয়া ও জাজিরায় দুটি সাবস্টেশন তৈরি করা হবে। নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্যাস এসে মাওয়ায় যুক্ত হয়ে সেতুর মধ্য দিয়ে জাজিরা যাবে। সেখান থেকে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোয় গ্যাস পৌঁছে যাবে।
২০০১ সালে মাওয়া পুরান ফেরিঘাটে মাছ বাজারসংলগ্ন এলাকায় এ সেতুর ফলক উন্মোচন করেন সেদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সরকার বদল হলে থেমে যায় কাজ। ২০০৯ সালে আবার তোড়জোড় শুরু হয় পদ্মা সেতুর কাজ। তখন দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জালে আটকা পড়ে এ সেতুর নির্মাণকাজ। একপর্যায়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে দাঁড়ায়। তখনই দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি দৃঢ়চেতা মনোভাব পোষণ করে সিদ্ধান্ত নেন পদ্মা সেতু করবেনই এবং তা হবে আমাদের দেশের নিজেদের টাকায়। যেমন কথা তেমন কাজ। অনেক চড়াই-উতরাই পার করে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু নির্মাণের সার্বিক কাজ শুরু হয়। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর শনিবার দুপুর ১টায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সুইচ চেপে মূল কাজের শুভ সূচনা করেন। ওই সময় উপস্থিত ছিলেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ দেশের প্রায় সব মন্ত্রী, এমপি, নেতা-কর্মী। এ কাজের জন্য বিদেশ থেকে আনা হয় বিশ্বের সেরা জার্মান হ্যামারসহ নানা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। পদ্মাপাড়ে শুরু হয় বিশাল কর্মযজ্ঞ। একে একে ৪০ তলা উঁচু দালানের মতো পিলারগুলোকে পানির নিচে বসিয়ে ৪২টি পিলার স্থাপন করা হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর প্রথম স্প্যান (স্প্যান-৭এ) বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। সেই থেকে ২০১৮ সালে ৪টি, ২০১৯ সালে ১৫টি এবং ২০২০ সালে ২১টি অর্থাৎ ৪০টি স্প্যান বসাতে পার হয়েছে তিন বছর দুই মাস ১০ দিন। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হতে থাকে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এরপর ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান বসানো সম্পন্ন হয়। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর সুপারস্ট্রাকচার পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়। একই সঙ্গে চলতে থাকে রোডওয়ে, রেলওয়ে স্লাব বসানোসহ অন্যান্য কাজ। গতকাল ২৩ আগস্ট সকালে লাল সূর্য উঁকি দিতেই রোডওয়ে স্লাব বসানোর কাজ শেষের মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর সড়কপথের পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়। এখন চোখের সামনে দেশবাসীর প্রিয় পদ্মা সেতু শুভ উদ্বোধনের অপেক্ষায় দৃশ্যমান।
মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার আবদুল মোমেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণ ঘিরে এ এলাকা সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার চাদরে ঘেরা রয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি এখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চৌকস দল রয়েছে। রয়েছে আনসারসহ নির্মাণ কর্তৃপক্ষের নিজস্ব কেয়ারটেকারও।
বাস্তবায়নে দায়িত্বে রয়েছেন যারা : নদীশাসনের দায়িত্বে রয়েছে চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। সেতুর মূল নির্মাণকাজের জন্য চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য যৌথভাবে আবদুল মোনেম লিমিটেড ও মালয়েশিয়ার হাইওয়ে কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট কাজ করে চলেছে। পদ্মা সেতুর কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। রেললাইনের কাজ করছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড কোম্পানি। গ্যাসলাইনের কাজ করছে চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। নিরাপত্তায় বিশেষ দায়িত্বে রয়েছেন পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য ও সেতু প্রকল্পের নিজস্ব প্রহরীরা।