ডেস্ক নিউজ
ঘুরে দাঁড়িয়েছে রপ্তানি বাণিজ্য। ১৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়ে গত অর্থবছর শেষ হলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বড় ‘ধাক্কা’ নিয়ে শুরু হয়েছিল অর্থবছর।
কিন্তু দ্বিতীয় মাস আগস্টে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে রপ্তানি। এই মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে গত বছরের আগস্টের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি আয় দেশে এসেছে। মূলত পোশাক রপ্তানির ওপর ভর করেই প্রবৃদ্ধিতে ফিরেছে বাংলাদেশ।
তবে অর্থবছরের দুই মাসের হিসাবে দশমিক ৩১ শতাংশ আয় কম এসেছে। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দশমিক ৩১ শতাংশ আয় কম এসেছে পণ্য রপ্তানি থেকে।
রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন, আগামী মাসগুলোতে রপ্তানি আয় বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকবে। বড় ধরনের আর কোনো সংকট দেখা না দিলে গত অর্থবছরের চেয়েও বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়ে এই অর্থবছর শেষ হবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বৃহস্পতিবার পণ্য রপ্তানির আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩৩৮ কোটি ৩০ লাখ (৩.৩৮ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অংক গত বছরের আগস্টের চেয়ে ১৪ দশমিক ০২ শতাংশ বেশি। তবে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম এসেছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
এই মাসে আয়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ৩৭১ কোটি ১০ লাখ ডলার। গত বছরের আগস্টে আয় হয়েছিল ২৯৬ কোটি ৭১ লাখ ডলার।
অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে পণ্য রপ্তানি থেকে ৬৮৫ কোটি ৬৫ লাখ (৬.৮৫ বিলিয়ন) বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে, যা গত বছরের জুলাই-আগস্টের চেয়ে দশমিক ৩১ শতাংশ কম।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই দুই মাসে রপ্তানির লক্ষ্য ছিল ৭৪৪ কোটি ডলার। গত বছরে আয় হয়েছিল ৬৮৭ কোটি ৮১ লাখ ডলার।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোরবানির ঈদের ছুটি এবং লকডাউনের কারণে ১০-১১ দিন পোশাক কারখানা বন্ধ থাকায় জুলাই মাসে রপ্তানি আয় কম এসেছিল। ১ আগস্ট থেকে কারখানা খুলেছে। প্রধান বাজার ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। মানুষ আগের মতো পোশাক কিনছে। প্রচুর অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে। ২৫ ডিসেম্বরের বড়দিনকে ঘিরেও ভালো অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে।
‘সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পোশাকের জন্য সুদিন আসছে বলেই মনে হচ্ছে। এখন যদি আর কোনো সমস্যা না হয়, তাহলে আগামী দিনগুলোতে পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি বাড়বে। এবারও একটা ভালো প্রবৃদ্ধি উপহার দিতে পারব আমরা।’
ফারুক হাসান বলেন, ‘জুলাইয়ে রপ্তানি আয় কম আসবে; এটা অবধারিত ছিল। ঈদের ছুটি ও লকডাউনের কারণে টানা ১১/১২ দিন সব কারখানা বন্ধ ছিল। উৎপাদন হয়নি; রপ্তানিও হয়নি।
‘আমরা ওই মাসের রপ্তানির চিত্র নিয়ে মোটেই বিচলিত ছিলাম না। আশার কথা হচ্ছে, সরকার আমাদের সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পোশাকের বড় বাজার ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। মানুষজন আগের মতো কেনাকাটা শুরু করেছে। আগামী দিনগুলোতে রপ্তানি বাড়বে। গত অর্থবছরের একটা ভালো প্রবৃদ্ধি নিয়ে এই অর্থবছরও শেষ হবে বলে আশা করছি।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের রপ্তানি খাত ভালো করবে। জুলাই মাসের বিষয়টা একেবারেই আলাদা; ১০/১২ দিন সবকিছু বন্ধ ছিল। রপ্তানি আয় আসবে কোত্থেকে? বিশ্ব বাণিজ্যের যে গতিবিধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বেশ বাড়বে। আগস্ট মাসের তথ্য সেটাই প্রমাণ করছে। আগামী মাসগুলোতে আরও ভালো হবে।
‘তবে, এখানে দুটি বিষয়ের উপর নির্ভর করছে আমাদের রপ্তানি খাত। প্রথমত, ভালো দিক হচ্ছে, ইউরোপ-আমেরিকায় পরিস্থিতি ভালোর দিকে। তারা এখন প্রচুর পোশাক কেনা শুরু করেছে। আমরা যদি তাদের চাহিদা অনুযায়ী পোশাক দিতে পারি, তাহলে রপ্তানি বাড়বে। কিন্তু সমস্যা যেটা সেটা হচ্ছে, আমরা কিন্তু করোনার টিকা প্রদানে এখনও অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের এখন টিকার দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। যে করেই হোক দেশের বেশিরভাগ মানুষকে দ্রুত টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘শুধু আমাদের প্রধান বাজারের অবস্থা ভালো হলে তো চলবে না। আমাদের করোনা পরিস্থিতিও ভালো করতে হবে। যদি আবার তৃতীয় ঢেউ দেখা দেয়; পরিস্থিতি খারা হয়-তাহলে কিন্তু সব সম্ভাবনা ভেস্তে যাবে।’
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই-আগস্ট সময়ে রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ১ দশমিক ২৭ শতাংশ। দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি কমেছে ৩৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
তবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত মাছ, কৃষি পণ্যসহ অন্য সব খাতের রপ্তানি আয় বেড়েছে।
জুলাই-আগস্ট সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৫৬৪ কোটি (৫.৬৪ বিলিয়ন) ডলার, যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ দশমিক ২৬ শতাংশ। এর মধ্যে জুলাইয়ে ২৮৮ কোটি ৭২ লাখ এবং আগস্টে ২৭৫ কোটি ৩৪ লাখ ডলার এসেছে। জুলাই মাসে গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে পোশাক রপ্তানি কমেছিল ১১ দশমিক ০২ শতাংশ। অগাস্টে তা বেড়েছে ১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
দুই মাসের হিসাবে প্রবৃদ্ধি কমেছে ১ দশমিক ২৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের এই দুই মাসে আয় হয়েছিল ৫৭১ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
জুলা-আগস্ট সময়ে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৩২৫ কোটি ৮৯ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
ওভেন পোশাক থেকে আয় হয়েছে ২৩৮ কোটি ১৭ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি কমেছে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
অন্যান্য খাত
অন্যান্য খাতের মধ্যে জুলাই-আগস্ট সময়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে ১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার আয় হয়েছে। গত বছরের এই দুই মাসে আয় হয়েছিল ১৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪ কোটি ২৮ লাখ ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই-আগস্ট দুই মাসে পাট খাতের রপ্তানি আয় কমেছে ৩৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ৪৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
এই দুই মাসে হিমায়িত মাছ রপ্তানি বেড়েছে ১৮ শতাংশ। কৃষিপণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১৩ শতাংশের মত।
ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ২১ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল রপ্তানি বেড়েছে ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ।
স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ২৩ শতাংশ।
১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের মোট লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাত থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা আছে ৩৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম।