ডেস্ক নিউজ
চার্টার্ড ফ্লাইটে যাচ্ছে নারী কর্মী : বেসরকারি এজেন্সিগুলো পিছিয়ে
বৈশ্বিক মহামারি করোনা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্ডানের শ্রমবাজারে নতুন কর্মী নিয়োগে উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে নারী কর্মীর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে বিশেষ চার্টার্ড ফ্লাইটে করে কর্মী নিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছে।
প্রবাসী মন্ত্রণালয় গঠিত বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লি. (বোয়েসেল) এর মাধ্যমে গত ২৮ জুলাই ৫টি চার্টার্ড ফ্লাইটে এবং গত ২৯ আগস্ট আরেকটি চার্টার্ড ফ্লাইটে করে ১৬০ জন নারী কর্মী আম্মানে গিয়ে কাজে যোগদান করেছেন। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আরো দু’টি চার্টার্ড ফ্লাইট যোগে নারী কর্মী যাবেন জর্ডানে।
বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মীদের জন্য এটা আশার আলো হয়ে ধরা দিয়েছে। এ ব্যাপারে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। বোয়েসেলের নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। এদিকে দেড় বছর পর মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ কুয়েত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিমান চলাচল শুরু হয়েছে।
জান গেছে, বর্তমানে জর্ডানে কর্মরত বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি পুরুষ—নারী কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন। একজন গার্মেন্টস কর্মী প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় করছেন। বোয়েসেলের শীর্ষ কর্মকর্তা শরিফ এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তার মতে, দেশটিতে বাংলাদেশি পুরুষ—নারী কর্মীরা অত্যন্ত সুনামের সাথে কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
বিএমইটির সূত্র জানায়, ২০০১ সাল থেকে গত মে মাস পর্যন্ত জর্ডানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ১ লাখ ৯২ হাজার ৩২৮ জন পুরুষ—নারী কর্মী চাকরি লাভ করেছে। করোনা মহামারির মাঝে দেশটির গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে প্রচুর বাংলাদেশি নারী কর্মীর চাহিদা রয়েছে। করোনার পর পশ্চিমা দেশগুলো জর্ডানের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো থেকে কাপড়জাত পণ্য আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছে। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো আমদানিকারকদের চাহিদানুযায়ী পণ্য সরবরাহে হিমসিম খাচ্ছে। দেশটির ৩৪টি বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক পক্ষ বাংলাদেশ থেকে বিনা অভিবাসন ব্যয়ে নারী কর্মী নিচ্ছে।
বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লি. (বোয়েসেল) এর মাধ্যমে বিমান ভাড়া, জর্ডানের রাজধানী আম্মান বিমানবন্দর সংলগ্ন হোটেল ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন ও করোনা টেস্ট—এর সকল ব্যয় বহন করেই নারী কর্মী নিচ্ছে ফ্যাক্টরিগুলো। জর্ডানে বাংলাদেশ থেকে অন্যান্য এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রয়েছে। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোর ব্যাপক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির সরকার শুধু বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে বিশেষ চার্টার্ড ফ্লাইটে কর্মী নেয়ার অনুমতি দিচ্ছে। এ যাবত বোয়েসেলের মাধ্যমে জর্ডানে ৭২ হাজার নারী কর্মী চাকরি লাভ করেছে।
বর্তমানে দেশটিতে লক্ষাধিক মহিলা কর্মী কাজ করে প্রচুর রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। দীর্ঘ এক বছর মহিলা গৃহকর্মী নিয়োগ বন্ধ থাকার পর করোনা মহামারির আগের বছর বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সীগুলো কর্মী নিয়োগের ভিসা পেতে শুরু করেছিল। জর্ডান সরকার নতুন নিয়মে বাংলাদেশি মহিলা গৃহকর্মীদের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স বাধ্যতামূলক করেছে। জর্ডানের রাজধানী আম্মানে নিযুক্ত বাংলাদেশী দূতাবাস কর্তৃপক্ষ নতুন ভিসায় সত্যায়ন দেয়া শুরু করেছিল। জর্ডানের আম্মানে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাস কতৃর্পক্ষ দেশটি শ্রমবাজার সম্প্রসারণে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিএমইটির সূত্র মতে, ২০১৬ সালে জর্ডানে ২৩ হাজার ১৭ জন মহিলা গৃহকর্মী চাকরি লাভ করেছে। ২০১৭ সালে দেশটিতে ২০ হাজার ৪৪৯ জন মহিলা গৃহকর্মী চাকুরি লাভ করেছে। ২০১৯ সালে দেশটিতে বাংলাদেশে থেকে যান ২০ হাজার ৩৪৭ জন কর্মী। ২০১১ সালে জর্ডানে মহিলা গৃহকর্মী নিযোগ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকে মহিলা গৃহকর্মী প্রেরণে প্রসেসিং ফি ৩০০ মার্কিন ডলার এবং টিকিটসহ অন্যান্য ফি ৪০০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। জর্ডানে কর্মরত মহিলা গৃহকর্মীরা থাকা—খাওয়া ফি এবং প্রতি মাসে ২০০ থেকে ২৫০ মার্কিন ডলার বেতন পাচ্ছে।
খেঁাজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালে জর্ডানে কর্মরত বাংলাদেশী মহিলা গৃহকর্মী মাসুদা বেগম দুই জন বৃদ্ধা জর্ডানী নাগরিককে হত্যা করে। স্থানীয় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এ মর্মান্তিক ঘটনার পর পর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দেয় জর্ডান সরকার। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিবও জর্ডান সফর করে শ্রমবাজার চালুর জন্য ওই দেশটির কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করেছিলেন।
পরবর্তীতে জর্ডান আদালত এক রায়ে অভিযুক্ত মাসুদা বেগমকে ফাঁসির নিদের্শ দেয়। জর্ডানে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাস কতৃর্পক্ষ মাসুদা বেগমের ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে আইনজীবির মাধ্যমে আদালতে আপিল করে। জর্ডানের কারাগারে নানা কারণে বেশ কিছু বাংলাদেশি মহিলা কর্মী আটক রয়েছে।
রিক্রুটিং এজেন্সিজ ঐক্য পরিষদের সভাপতি মো. টিপু সুলতান গতকাল বলেছেন, জর্ডানে একজন বাংলাদেশী মহিলা গৃহকর্মীর দ্বারা একটি অপ্রীতিকর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটিতে শ্রমবাজার দীর্ঘ দিন বন্ধ ছিল। জর্ডানে গৃহকর্মী ওয়ার্কার্স এসোসিয়েশন অব জর্ডান বাংলাদেশি মহিলা গৃহকর্মী নিয়োগের লক্ষ্যে শতাধিক ভিসা ইস্যু করেছিল।
টিপু সুলতান বলেন, জর্ডান শ্রমবাজারে বেসরকারি পর্যায়ে নারী কর্মী প্রেরণ কোয়ারেন্টিন জটিলতায় অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে। নিয়োগকর্তা (কফিল) কোয়ারেন্টিন খরচ দিতে রাজি হচ্ছে না। দুই ডোজ টিকা প্রাপ্ত কর্মীকেই তারা নেয়ার জন্য আগ্রহী। বিদেশগামীদের যথা সময়ে টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অসংখ্য বিদেশগামী কর্মী ১ মাসের অধিক সময় অতিক্রম হওয়ার পরেও টিকা নেয়ার জন্য ম্যাসেজ পাচ্ছেনা। অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। মূলত টিকা সংক্রান্ত জটিলতার কারণেই বেসরকারি পর্যায়ে জর্ডান শ্রমবাজারটি স্থবির হয়ে আছে।
বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো জর্ডানে গ্রার্মেন্টস কর্মী পাঠাতে পারছে না। রিক্রুটিং এজেন্সিজ ঐক্য পরিষদের পক্ষ হতে তিনি সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে জর্ডানে গার্মেন্টস কর্মী প্রেরণের সুযোগ প্রদানের জন্য প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীর নিকট জোর দাবি জানান।
করোনা পরিস্থিতিতে জর্ডানে খাদ্য সঙ্কটে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি দেশটিতে শ্রমবাজার সুরক্ষায় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জর্ডানে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাস। জর্ডানের পোশাকশিল্পে প্রায় ৪৫ হাজার বাংলাদেশি কর্মরত আছেন। সেখানকার পোশাক কারখানার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছে বাংলাদেশ দূতাবাস। জর্ডানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত জর্ডানের ইরবিদ শহরের বিভিন্ন পোশাক কারখানার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। রাষ্ট্রদূত জর্ডানের সর্ববৃহৎ পোশাক কারখানা ক্লাসিক ফ্যাশন্স এপারেলস লিমিটেড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সার্বিক অবস্থার বিষয়ে অবগত হন। যেকোনো পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের সহায়তার বিষয়ে দূতাবাস সচেষ্ট বলেও জানান তিনি। ক্লাসিক ফ্যাশন্স অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানায় প্রায় পনের হাজার দক্ষ বাংলাদেশি পোশাক শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন।
একজন শ্রম বিশ্লেষক জর্ডানের শ্রমবাজার প্রসঙ্গে বলেন, জর্ডানের জীবনমান খুবই উন্নত। জর্ডানের কর্মরত বাংলাদেশি মহিলা কর্মীরা যাতে কোনো প্রকার অনৈতিক কাজে জড়িয়ে না পড়ে সে দিকে নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, সউদী আরবের রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস অভিবাসী নারী কর্মীদের আইনি সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। জর্ডানে গিয়েও যাতে বাংলাদেশী মহিলা কর্মীরা শর্তানুযায়ী বেতন এবং কর্মস্থলে নিরাপত্তা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। জর্ডানগামী সকল কর্মীদের দ্রুত করোনা টিকা দেয়ার জোর দাবি জানান।