ডেস্ক নিউজ
করোনা মহামারির প্রভাব সামলে উঠছে আবাসন খাতে। করোনার টিকাদান, বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ রাখা, ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি হ্রাস এবং কম সুদে ঋণ সুবিধা থাকায় ফ্ল্যাট বিক্রি বেড়েছে। নতুন করে বুকিংও বেড়েছে। এ কারণে আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা পাইপলাইনে থাকা প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন। হাত দিয়েছেন নতুন প্রকল্পেও। তবে ফ্ল্যাটের দামও বাড়ছে। উদ্যোক্তারা এর কারণ হিসেবে রড, সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করেছেন।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সূত্রে জানা গেছে, বছরে সাধারণত আবাসন খাতে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে ফ্ল্যাটের বুকিং বেড়ে যাওয়ায় এবার বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি।
আবাসন কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, এ খাতে মন্দা শুরু হয় ২০১২ সালের দিকে। ওই সময় ফ্ল্যাটের মূল্য কমিয়েও ক্রেতা খুঁজে পায়নি অনেক প্রতিষ্ঠান। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয় ২০১৬ সালের দিকে। ২০১৮ সালে সরকারি কর্মচারীদের ৫ শতাংশ সুদে গৃহঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে ফ্ল্যাট নিবন্ধন ব্যয় কমানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। আগে নিবন্ধন ব্যয় ছিল ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ থেকে ১২ দশমিক ৫ শতাংশে। এসব কারণে আবাসন ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। কিন্তু গত বছর মার্চের শুরুতে করোনা মহামারি শুরু হলে এতে ভাটা পড়ে। তবে চলতি বছরে আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে আবাসন খাত। বিক্রেতাদের হাতে থাকা প্রায় সব রেডি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেছে। বুকিংও বেড়ে গেছে।
রিহ্যাব সূত্রে জানা গেছে, সংগঠনটির সদস্য রয়েছে প্রায় ১২শ। এর বাইরেও বহু আবাসন কোম্পানি রয়েছে যারা রিহ্যাবের সদস্য নয়। সদস্যদের এই মুহূর্তে ২৮ হাজার ৫১০টি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণাধীন আছে। এর মধ্যে বিক্রয়যোগ্য প্রায় ৬০ শতাংশ। এগুলোর মধ্যে ইতোমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে ৫ হাজার ৭শ ইউনিট। অবিক্রীত রয়েছে সাড়ে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার ইউনিটের মতো।
রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন সমকালকে বলেন, বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ, নিবন্ধন ফি হ্রাস, সরকারি চাকরিজীবীদের ৫ শতাংশ সুদে ঋণ এবং ব্যাংকিং খাতে আমানতের সুদ কমে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে ফ্ল্যাট কেনার আগ্রহ বেড়েছে। এখন ফ্ল্যাটের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। রেডি ফ্ল্যাট সবই বিক্রি হয়ে গেছে। ক্রেতারা নতুন করে বুকিং দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় উদোক্তারা সংকটে পড়েছেন। এক বছরে প্রতি টন রডের দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা। সিমেন্টের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া কেবলের দাম বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ।
বিল্ডিং ফর ফিউচার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীরুল হক প্রবাল সমকালকে বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে আসায় ফ্ল্যাট বিক্রি বেড়েছে। তবে নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা ক্রেতাদের ওপর পড়বে। নির্মাণসামগ্রীর সঙ্গে সম্পৃক্ত সম্পূরক শুল্ক্ক, ভ্যাট ও কর কমিয়ে দিলে এসব পণ্যের দাম কমতে পারে। তখন নির্মাণ ব্যয়ও কমে আসবে। ট্রপিক্যাল হোমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রবিউল হকও জানিয়েছেন, তার কোম্পানির বেচাবিক্রি মোটামুটি ভালো।
শেলটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ বলেন, করোনার প্রভাব এখনও কাটেনি। পুনরুদ্ধারে দেড়-দুই বছর সময় লাগবে। বুকিং বাতিল হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। তবে করোনা সংক্রমণ কমে গেলে ব্যাংকিংসহ অন্যান্য সহায়তা পেলে অচিরেই তা ঘুরে দাঁড়াবে।
রিহ্যাবের সহসভাপতি কামাল মাহমুদ রাজউকের কিছু সমস্যা তুলে ধরে বলেন, রাজউকে অনেক সময় ফাইল আটকে থাকে। নানা অজুহাতে ফাইল এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ঘোরে। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তার মতে, আবাসন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে রাজউকের ভূমিকা আরও সহযোগিতামূলক হতে হবে। প্রকল্প ঋণ চালু করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে নির্মাণসামগ্রীর সঠিক দাম নির্ধারণ করতে হবে।
রিহ্যাবের সাবেক প্রথম সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া সমকালকে বলেন, সরকার কয়েকটি সুবিধা দেওয়ায় গ্রাহকদের ফ্ল্যাটের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। মোট ক্রেতার প্রায় অর্ধেকই চাকরিজীবী পর্যায়ের। কারণ সরকারি চাকরিজীবীরা এখন ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন। ব্রিক ওয়ার্কস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০ শতাংশ বিক্রি বেড়েছে। রেডি ফ্ল্যাট সবই বিক্রি হয়েছে। নতুন করে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন তিনি। আবাসন খাত বিস্তৃত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন শুধু ঢাকায় নয়, গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী, জামালপুর, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলা পর্যায়েও কাজ শুরু করেছেন আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা। এ খাতে কর্মসংস্থানও বাড়ছে।
নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি: ভবন তৈরিতে সাধারণত ৬০ গ্রেডের রড বেশি ব্যবহূত হয়। রাজধানীর পূর্ব তেজতুরী বাজারে কয়েকটি রড সিমেন্টের দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, এই গ্রেডের রডের টন সর্বোচ্চ ৭৪ হাজার ৫শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম কোম্পানিভেদে ৪২০ থেকে ৪৮০ টাকা। গত বছরের শেষ দিকে গড়ে সিমেন্টের দাম ৩৬০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে ছিল। এ বিষয়ে চিটাগাং রোডের খান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী উজ্জ্বল খানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, বস্তাপ্রতি সিমেন্টের দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেড়েছে। রডের দামও বেড়েছে টনপ্রতি ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা।
সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্যেও রডের দাম বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে। সংস্থাটির দৈনিক বাজার প্রতিবেদন অনুযায়ী এমএস ৬০ গ্রেডের প্রতি টন রডের সর্বোচ্চ বাজারদর ৭৫ হাজার ৫০০ টাকা। এই ধরনের রডের দাম এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২৯ দশমিক শতাংশ। এ ছাড়া ৪০ গ্রেডের প্রতি টন রডের বর্তমান বাজারদর সর্বোচ্চ ৭০ হাজার ৫০০ টাকা। এই গ্রেডের রডের দাম এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
উৎপাদনকারীরাও স্বীকার করেছেন, রডের দাম বাড়ছে। কেন বাড়ছে তার ব্যাখ্যাও দেন তারা। তারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে গলনশীল স্ট্ক্র্যাপের (রড তৈরির প্রধান কাঁচামাল) ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এর মোট চাহিদার ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া রড তৈরির কেমিক্যালের দাম ও জাহাজ ভাড়া বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক। ফলে রডের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
রড উৎপাদনকারী পিএইচপি ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বিশ্ববাজারে আগে স্ট্ক্র্যাপের দাম ছিল ৩৫০ থেকে ৪০০ ডলার। এখন কিনতে হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬০০ ডলারে। জাহাজ ভাড়াও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। তিনি বলেন, রডের চাহিদার বেশির ভাগ জোগান আসে চট্টগ্রামে ভাঙা জাহাজের স্ট্ক্র্যাপ থেকে। কিন্তু সেখানে আগে দাম ছিল টন প্রতি ৩০ থেকে ৩১ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৪৮ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এসব কারণে রডের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
এইচআর রি-রোলিং মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান খোকন জানান, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশ থেকে স্ট্ক্র্যাপ আমদানি করে বাংলাদেশ। কিন্তু করোনায় এসব দেশে লকডাউন দেওয়ায় স্ট্ক্র্যাপ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সময়ে প্রতি টন স্ট্ক্র্যাপের দাম ছিল প্রায় ৩০০ থেকে ৩২০ ডলার। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০ থেকে ৫২০ ডলারে। এ ছাড়া রড তৈরির কেমিক্যাল ফেরো সিলিকো ম্যাঙ্গানিজের কেজি ছিল ৯৫ ডলার। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৪৫ ডলার। এক টন রড তৈরি করতে কমপক্ষে ১৪ কেজি সিলিকো ম্যাঙ্গানিজ লাগে। এ হিসেবে প্রতি টন রডে ৭০০ টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। এ ছাড়া সিলিকো ম্যাঙ্গানিজ আমদানিতে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ রেগুলার ডিউটি রয়েছে। ফলে আমদানি করা যাচ্ছে না। এই শুল্ক্ক কমানো উচিত। তবে রডের বর্ধিত দাম এখন কমছে দাবি করেন তিনি।
ফ্ল্যাট ও প্লটের দাম ঊর্ধ্বমুখী: রিহ্যাব সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ফ্ল্যাটের দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ৭ হাজার টাকা। তবে বর্তমানে ওই এলাকায় দাম প্রায় ৯ হাজার টাকা। কলাবাগান এলাকায় প্রতি বর্গফুটের দাম ২০১০ সালে ছিল ৭ হাজার টাকা। এখন সেখানে দাম প্রায় সাড়ে ৯ হাজার টাকা। এক দশক আগে ঢাকার অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত বনানীতে প্রতি বর্গফুটের দাম ছিল ১৩ হাজার টাকা। দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। এ ছাড়া ধানমণ্ডি, গুলশান, বারিধারা, লালমাটিয়া, মিরপুর, উত্তরা, শ্যামলী, কলাবাগান ও শান্তিনগর এলাকায়ও ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) সদস্য বারিধারা হাউজিং লিমিটেডের পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ জাকির হোসাইন সমকালকে বলেন, জমির প্লটের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে সব জায়গায় নয়। যেগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো সেগুলোর দাম বেড়েছে। মুন্সীগঞ্জভিত্তিক তাদের একটা প্রকল্প আছে। সেখানে যে জমির শতাংশ ৫ লাখ টাকা ছিল এখন তা প্রায় ৭ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সব জায়গায় জমি বা ফ্ল্যাটের দাম বাড়েনি বলে জানান আবাসন প্রতিষ্ঠান দ্য স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি মো. আবদুল আউয়াল। তিনি সমকালকে বলেন, মহাখালীতে ৭৩ কাঠার ওপর তাদের বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। কিন্তু এখানে তেমন দাম বাড়েনি। বিক্রিও কম। তবে কলাবাগান, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর এলাকার দিকে ক্রেতাদের চাহিদা বাড়ছে।