ডেস্ক নিউজ
মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যে ভারতে পণ্য রপ্তানিতে উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে পোশাক রপ্তানি বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আগামী দিনগুলোতে পাশের এই দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি আরও বাড়বে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন রপ্তানিকারকরা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ভারতে ২৭ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। বর্তমান বাজারদরে টাকার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ২০ পয়সা) এই অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা।
রপ্তানির এই অংক গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ের চেয়ে ৬০ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই দুই মাসে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৭ কোটি ১২ লাখ ডলার।
জুলাই-আগস্ট সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ; শতাংশ হিসাবে বেড়েছে ৮১ দশমিক ৩২ শতাংশ। এই দুই মাসে ওভেন পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ৫ কোটি ২৭ লাখ ৬০ হাজার ডলার। আর নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪ কোটি ১৯ লাখ ডলার।
২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ভারতে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৫ কোটি ২২ লাখ ডলারের বিদেশি মুদ্রা।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি ১২৮ কোটি ডলারে গিয়ে ওঠে, যা ছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতের বাজারে ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল; যা ছিল এর আগে সর্বোচ্চ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে ১০৯ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলারে নেমে আসে।
তার আগের বছরগুলোতে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলারের নিচে।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমএইএ-এর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভৌগলিক কারণেই ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ছে। এখন থেকে বাড়তে থাকবেই বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। প্রায় দেড়শ কোটি লোকের চাহিদা মেটাতে ভারতকে বাংলাদেশ থেকে পোশাক কিনতেই হবে। ভারতে পোশাক তৈরি করতে যে খরচ হয়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করলে তার থেকে অনেক কম পড়ে। সে কারণে সব হিসাব-নিকাশ করেই তারা এখন বাংলাদেশ থেকে বেশি বেশি পোশাক কিনছে।’
তিনি বলেন, ‘ভারতের অনেক ব্যবসায়ী এখন বাংলাদেশের কারখানায় পোশাক তৈরি করে তাদের দেশে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছে। এতে তাদের একদিকে যেমন লিড টাইম কম লাগছে, অনদিকে খরচও কম হচ্ছে।
‘এ ছাড়া আগস্টের প্রথম দিকে ভারত সরকারকে বাংলাদেশের রপ্তানি-আমদানি বাণিজ্য দ্রুত ও সহজ করতে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। তার ইতিবাচক ফলও পাওয়া যাচ্ছে।’
সব মিলিয়ে ভারতের বিশাল বাজার বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য আগামীতে ‘সুদিন’ বয়ে আনবে বলে মনে করছেন রুবেল।
পোশাক ছাড়া অন্য পণ্য
তৈরি পোশাক ছাড়া ভারতে পাট ও পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক দ্রব্য ও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ১ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ২৩ লাখ ডলারের। প্লাস্টিক দ্রব্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২২ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
ভারত সরকারের যে সুবিধায় রপ্তানিতে উল্লম্ফন
২০১১ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দক্ষিণ এশিয়ার স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ভারতের স্পর্শকাতর পণ্যতালিকা ৪৮০টি থেকে মাত্র ২৫টিতে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেন। এর মধ্য দিয়েই কার্যত বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে প্রায় শতভাগ শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা প্রদান করা হয়।
প্রতিবেশী হওয়ায় বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় এখানে কম খরচে পণ্য রপ্তানি হওয়ার কথা। স্বাভাবিক নিয়মেই এই বিপুল পরিমাণ শুল্ক সুবিধায় বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ার কথা।
এই সম্ভাবনা দেখে ২০১৮ সালের এক গবেষণায় বিশ্বব্যাংক বলেছিল, বাণিজ্য সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানো গেলে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উন্নীত হতে পারে।
কিন্তু বাস্তবে তা বাড়ছে না, উল্টো আমদানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রপ্তানির গতি ও চাহিদা প্রত্যাশিত হারে না বাড়াসহ নানারকম অশুল্ক বাধার বেড়াজালে এখনও দুই দেশের বাণিজ্যে যোজন-যোজন দূরত্ব। একই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যও ৯ বিলিয়ন ডলারের বৃত্ত অতিক্রম করতে পারছে না।
তবুও বিরাট বাণিজ্য ঘাটতি
রপ্তানি কিছুটা বাড়লেও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির ফারাক এখনও বেশ বড়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতে পণ্য রপ্তানির তথ্য পাওয়া গেলেও দেশটি থেকে কী পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হয়েছে তার পুরো তথ্য এখনও প্রকাশ করেনি দুই দেশের কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ।
ফলে গত অর্থবছরে দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কত ছিল, সেটি এখনও জানা যায়নি। তার আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে ১০৯ কোটি ৬৩ লাখ ৮০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। আর বিপরীতে আমদানি করা হয় ৫৭৯ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের পণ্য। এ হিসাবে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫৬৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭৬৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ। বিপরীতে রপ্তানি করেছিল ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য। বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৬৪০ কোটি ডলার।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৪৫ কোটি ২৯ হাজার ডলার। রপ্তানির অঙ্ক ছিল ৬৯ লাখ ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৪৭৬ কোটি টাকা।
‘কিছু উদ্যোগ নিলে রপ্তানি আরও বাড়বে’
এক সময় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর ভারত কাউন্টার ভেইলিং ডিউটি (সিভিডি) আরোপ করেছিল। ২০১৪ সালে তা প্রত্যাহার করা হয়। এখন পাটজাত পণ্যে ধার্য করা হয়েছে অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি। ফলে ভারতের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না বাংলাদেশ।
সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে কিছু উদ্যোগ নিলে ভারতে রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন ইন্দোবাংলা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্কসুবিধা নেই। সেখানে বাড়তি শুল্ক দিয়ে পণ্য পাঠানো সত্ত্বেও প্রতি বছর আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। অথচ ভারতের বাজারে আমরা প্রায় শতভাগ শুল্ক সুবিধা পেয়েও পোশাক রপ্তানি একটা কাউন্টেবল জায়গায় নিতে পারছি না। বুঝতে হবে সেখানে চাহিদা সৃষ্টিতে কোথায় আমাদের দুর্বলতা। শুধু পোশাক নয়, সব রপ্তানি পণ্যেরই একই অবস্থা।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য পুরোপুরি ভারতের অনুকূলে। তবে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৩৭ গুণ। কিন্তু তাতেও ঘাটতি কমেনি।’
মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘ভারতে রপ্তানি আশানুরূপ বাড়বে না, যদি আমরা ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা তৈরি করতে না পারি। তা করতে হলে সবার আগে দরকার গতানুগতিক বা সমজাতীয় পণ্যের রপ্তানির ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে আসা এবং নতুন ও বৈচিত্র্যময় পণ্য সেখানে নিয়ে যাওয়া।’
তিনি বলেন, ‘পণ্যভিত্তিক বাজারের সঠিক পর্যালোচনারও দরকার হবে। যার মাধ্যমে চাহিদা আছে এমন পণ্য রপ্তানির জন্য নির্বাচন করা সম্ভব হবে। এতে স্বাভাবিক নিয়মেই বাড়বে বাজার। কিন্তু এর জন্য নিজেদেরও কিছু কাজ করতে হবে। রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা, উৎপাদিত পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ ও গুণগত মান বাড়ানোতেও নজর থাকা জরুরি। এতে রপ্তানি পণ্যের ন্যায্য দামও মিলবে।
‘তবে এখন একটা বেশ ভালো পরিবেশ দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে দুদেশের সরকারের মধ্যেও বেশ ভালো সম্পর্ক বিরাজ করছে। আমার মনে হয়, আমরা কিছু উদ্যোগ নিলে এখন ভারতে আমাদের রপ্তানি বাড়বে,’ বলেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সাবেক সভাপতি মাতলুব।
বেনাপোল বন্দরে পণ্যবোঝাই ট্রাকের লাইন
দেশের প্রধান স্থলবন্দর যশোরের বেনাপোল বন্দর দিয়ে হঠাৎ ভারতে পণ্য রপ্তানি বেড়ে গেছে। নিউজবাংলার বেনাপোল প্রতিনিধি সোমবার বন্দর পরিদর্শন করে জানান, বন্দরে পণ্যবোঝাই ট্রাক উপচে পড়ছে। রাস্তার ওপর যত্রতত্র স্থানে পণ্যবোঝাই ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। জায়গা না থাকায় ভারতের পেট্রাপোল স্থলবন্দর থেকে পণ্যবোঝাই ট্রাক বাংলাদেশে ঢুকতে করতে পারছে না।
নিউজবাংলার প্রতিনিধি জানান, বেনাপোল স্থলবন্দরের ট্রাক টার্মিনাল ও আশপাশে পণ্যবোঝাই প্রায় ৫০০টি ট্রাক রাখার জায়গা আছে। অন্যদিকে ভারতের পেট্রাপোলে আছে ১ হাজার ৪০০ ট্রাক রাখার জায়গা।
তবে দুই স্থলবন্দরে এখন আর পণ্যবোঝাই ট্রাক রাখার জায়গা নেই। তাই নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে রাস্তার ওপর রাখা হয়েছে ট্রাক। এতে দেখা দিয়েছে তীব্র যানজট। দুই দেশগামী যাত্রীদের পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে।
বেনাপোল স্থলবন্দরের উপপরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবির তরফদার বলেন, ‘গত ১৫ দিন ধরে ভারতে পণ্য রপ্তানি বেড়ে গেছে। আগে দিনে ভারতে রপ্তানির জন্য ১০০ থেকে ১৫০টি ট্রাক রপ্তানি পণ্য নিয়ে আসত। এখন সেখানে দিনে তিন শতাধিক ট্রাক পণ্য নিয়ে আসছে। কিন্তু ভারত দিনে ২১৫টি ট্রাকের বেশি নিতে পারছে না। ফলে পণ্যের জট বেঁধে যাচ্ছে।’