ডেস্ক নিউজ
কক্সবাজারের মহেশখালীতে সরকার তৈরি করছে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বড় হাব। এর আওতায় এখানে নির্মিত হচ্ছে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পাঁচটি এলএনজি ও এলপিজি টার্মিনাল, তেল সংরক্ষণাগার ও শোধনাগার, গভীর সমুদ্র থেকে জ্বালানি তেল খালাসে স্থাপন করা হচ্ছে ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন। মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি ও ধলঘাটায় প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণকে ঘিরে এখন চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। আর এ উন্নয়ন কর্মষজ্ঞের ছোঁয়ায় এরই মধ্যে সমুদ্র তীরবর্তী এ উপজেলা এবং এর স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনমান বদলে যেতে শুরু করেছে। মাছ ধরে, শুঁটকি তৈরি করে, পান চাষ করে এবং লবণ উৎপাদন করেই যে অঞ্চলের মানুষ এতকাল জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন তারাই এখন এ অঞ্চলের এত অভূতপূর্ব উন্নয়নষজ্ঞে নতুন করে উন্নত জীবনের স্বপ্ন বুনছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ কাজ শেষ হলে এ অঞ্চল তো বটেই, গোটা দেশ পাবে নতুন এক চেহারা। সরেজমিন মহেশখালীর মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, সাগরের কোলঘেঁষে বিশাল এলাকাজুড়ে চলছে মাতারবাড়ি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ। জাপানের জাইকার অর্থায়নে এরই মধ্যে সেখানে এগিয়ে চলছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ভৌত অবকাঠামোগত কাজ। এগিয়ে চলছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের কাজ। পাল্লা দিয়ে চলছে ঘাট থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাওয়ার যোগাযোগ অবকাঠামোগত কাজ। এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় চার বছর আগে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায় কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড। প্রথম ধাপে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুটি ইউনিট চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। যার প্রতিটি থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসবে। দেশি-বিদেশি প্রায় ৭ হাজার শ্রমিক ও প্রকৌশলী প্রকল্পে কাজ করছেন। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এরই মধ্যে সমুদ্রপথে কয়লা আমদানির জন্য ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য, ২৫০ মিটার প্রস্থ এবং ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীরতার চ্যানেল খননের কাজ প্রায় শেষ। প্রস্তুত করা হয়েছে দুটি শক্তিশালী জেটি। যার একটিতে বড় জাহাজে আনা কয়লা এবং অন্যটিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তেল খালাস হবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা আনতে সমুদ্রে প্রশস্ত ও গভীর চ্যানেল খনন, জেটি নির্মাণ, প্রকল্প বাস্তবায়নের সুবিধার্থে স্থানীয়ভাবে নির্মিত রাস্তাঘাট, সেতুসহ অবকাঠামোগত নানা উন্নয়নের সুবিধা পাচ্ছে এ উপজেলায় বাস্তবায়নাধীন ও পরিকল্পনাধীন সরকারি-বেসরকারি ৩৭টি প্রকল্প। সরকারের নীতি-নির্ধারকরা মনে করছেন, কাজ শেষ হলে মহেশখালীর এসব প্রকল্প এ অঞ্চলের অভূতপূর্ব উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে।
মহেশখালী জ্বালানি হাব : মহেশখালী জ্বালানি হাব গড়ে তুলতে বাস্তবায়িত হচ্ছে কয়েকটি প্রকল্প। এটি হবে দেশের আমদানিকৃত জ্বালানির প্রাণকেন্দ্র। এর মধ্যে রয়েছে একাধিক তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) টার্মিনাল, তরলিকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) টার্মিনাল, তেল সংরক্ষণাগার ও তেল শোধনাগার। এখান থেকে দেশের সব আমদানি করা তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় পাঠানোর জন্য গভীর সমুদ্রে স্থাপন করা হচ্ছে ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন। এরই মধ্যে সাগরে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিদিন গড়ে ৮০-৯০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ হচ্ছে জাতীয় সঞ্চালন পাইপলাইনে। এর বাইরে আরও তিনটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ধলঘাটের স্থলভাগে দুটি এবং সাগরে আরেকটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। সব মিলিয়ে টার্মিনালগুলোর ক্ষমতা হবে ৩৫০ কোটি ঘনফুট। দেশের গ্যাসের চাহিদার বড় অংশ এখানকার এলএনজি দিয়েই পূরণ করা হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মালিকানায় মাতারবাড়ির ধলঘাটে একটি এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর সঙ্গে মহেশখালীর কালারমারছড়ায় তেল মজুদের বিশাল অবকাঠামো গড়ে তুলেছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। এর মাধ্যমে তেল খালাসের সনাতন ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ের (এসপিএম) মাধ্যমে নতুন ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এসপিএমের অবকাঠামো হিসেবে গভীর সমুদ্রে স্থাপন করা হয়েছে বিশেষ এক ধরনের বয়া। যার ভিতর থাকবে পাইপলাইন। এ পাইপলাইনের মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে স্থলভাগের তেল সংরক্ষণাগারে তেল আসবে। এসপিএমের মাধ্যমে একটি জাহাজ থেকে ১ লাখ টন তেল খালাস করতে মাত্র ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা সময় লাগবে। অথচ আগে এ পরিমাণ তেল খালাসে সময় লাগত ১১ দিন। এরই মধ্যে সমুদ্রের তলদেশে এ জন্য ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মধ্যে ১৩৫ কিলোমিটার লাইন স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া বিপিসির মালিকানায় ধলঘাটায় একটি তেল শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। বেসরকারিভাবে একটি প্রতিষ্ঠানও এখানে তেল শোধনাগার নির্মাণ করবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মহেশখালীতে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে তাতে ভবিষ্যতে এ এলাকা ‘হংকং’-এর মতো হয়ে উঠবে। এখানে একদিকে যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটছে অন্যদিকে এ বিশাল উন্নয়ন কাজের জন্য প্রায় লাখখানেক স্থানীয় বাসিন্দার কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আর যে স্থানীয় বাসিন্দাদের জমি প্রকল্পের কাজে অধিগ্রহণ করা হয়েছিল তাদের জন্যও আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর বাইরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে মাতারবাড়িতে নির্মিত হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। গভীর সমুদ্রবন্দরে পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য রেল ও সড়কপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। নির্মিত হবে তিনটি ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল। এ অঞ্চলে হবে তিনটি অর্থনৈতিক জোন। সোনাদিয়া দ্বীপে একটি ইকোপার্ক স্থাপনেরও পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।