ডেস্ক নিউজ
বৈশ্বিক মহামারী করোনা নিয়ন্ত্রণে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে দফায় দফায় লকডাউন ও বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। এ অবস্থায় স্থবির হয়ে পড়ে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জনজীবন। বর্তমানে করোনা নিয়ন্ত্রণে। চালু হয়েছে শিল্পকারখানা ও ব্যবসাবাণিজ্য। কলকারখানাসহ সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডস্থল খুলে দেওয়ায় বেড়েছে রপ্তানি আয় ও রপ্তানি আদেশ, শেয়ারবাজারে ফিরেছে ঊর্ধ্বগতি, প্রাণ ফিরে পেয়েছে পর্যটনকেন্দ্রগুলো। খরা কাটতে শুরু করেছে বিনিয়োগেও। ব্যবসা বেড়েছে পণ্য ও সেবা খাতে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অর্থনীতি গতিশীল রাখতে সরকারের প্রণোদনা ঘোষণা ছিল সময়োপযোগী পদক্ষেপ। সরকার প্রদত্ত প্রণোদনার অর্থ ও নীতি সহায়তা এবং লকডাউন উঠে যাওয়ায় দেশের সার্বিক অর্থনীতি দেড় বছর পর আবার ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে।
রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী এমপি আমাদের সময়কে বলেন, অর্থনীতির চাকা আবার ঘুরতে শুরু করেছে। স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হচ্ছে। ঘরবন্দি থেকে মানুষ বের হচ্ছে। আশা করি অর্থনীতির এ গতিধারা অব্যাহত থাকলে আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে পারব। তবে টিকাকরণের ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন এ ব্যবসায়ী নেতা।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বিপুলসংখ্যক মানুষকে করোনার টিকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। তাই সেসব দেশের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্ত মৌসুমের জন্য করোনার আগের মতো ক্রয় আদেশ দিচ্ছে। তা ছাড়া মিয়ানমারে সেনাশাসন ও ভারতে করোনার ভয়াবহতার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তর করা হচ্ছে। বড়দিন কেন্দ্র করেও প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে। তার আগেই চীন থেকে কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে স্থানান্তর করেন ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা। সম্প্রতি ভিয়েতনামে করোনার লকডাউন থাকার কারণেও কিছু ক্রয়াদেশ আসছে। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালের তুলনায় ১৫-২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বেশি এসেছে।
পোশাক রপ্তানি করোনার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে এরই মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের আগস্টে ২৭৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই মাসের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ বেশি।
বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরকারের দেওয়া প্রণোদনা ঋণ বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করছে। তবে প্রণোদনার ঋণে বিভিন্ন খাতের বড় শিল্প গ্রুপের অনেকে ছন্দে ফিরলেও কারও কারও বিরুদ্ধে স্বল্প সুদের এ অর্থ ভিন্ন কাজে ব্যয়ের অভিযোগও রয়েছে।
শিল্প ও সেবা খাতের জন্য প্রণোদনা তহবিল ৩৩ হাজার কোটি টাকার। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে এ তহবিলের ঋণ বিতরণ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত দুই হাজার প্রতিষ্ঠান এ তহবিল থেকে ৩২ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ। এর মধ্যে অর্ধেক সুদ জনগণের করের টাকায় সরকার বহন করছে। বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে ঋণগ্রহীতা ব্যবসায়ীদের। এই ঋণের শর্ত শুধু চলতি মূলধন হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোই কেবল এ ঋণ পাচ্ছে। প্রণোদনার ঋণ নিয়ে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, লজিস্টিক সাপোর্ট ভালো থাকায় বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো করোনার মধ্যেও তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তারা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা দিয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান ছোট হওয়ার কারণে রাজস্ব কম দেয়, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। ফলে রাজস্ব আহরণ তথ্য হেলদি দেখাচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, কোডিভ-১৯ মহামারীর মধ্যেও ভালো করেছে দেশের পণ্য ও সেবা খাতের প্রায় সব বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ২০২১ অর্থবছরে কসমেটিক্স, টেলিকম থেকে শুরু করে সিগারেট, আবাসন, তেল-গ্যাস, ওষুধ, রড, সিমেন্ট, সিরামিক্স, বেভারেজ, ব্যাংকিংসহ প্রায় সব খাত থেকে ডাবল ডিজিটের বেশি রাজস্ব প্রবৃদ্ধি পেয়েছে এনবিআর।
২০২১ অর্থবছরে এনবিআর সিগারেট, টেলিকম, হাউজিং, ফার্মাসিউটিক্যালস, ব্যাংক, ফাস্ট-মুভিং ভোগ্যপণ্য, উৎপাদন, নির্মাণ ও অন্য কিছু ব্যবসা থেকে রাজস্ব সংগ্রহে প্রায় ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে ২০২১ অর্থবছরে দেশে পণ্য বিক্রির বিপরীতে সর্বোচ্চ ২৮ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে সিগারেট শিল্প। পণ্য ও সেবা খাতে সংগৃহীত মোট রাজস্বের প্রায় ২৭ শতাংশ এসেছে এ খাত থেকে। করোনার মধ্যেও পণ্য বিক্রিতে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো।
গত অর্থবছরে দেশের চারটি ফোন কোম্পানির রিচার্জের বিপরীতে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ রাজস্ব আদায় বেড়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। ২০২০ অর্থবছরে ফোন কোম্পানিগুলোর ট্যাক্স বাবদ রাজস্ব শেয়ারিং ছিল ৬ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। মোবাইল রিচার্জের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ শতকরা ২৫ শতাংশ পায় সরকার। যদিও সেলফোন অপরেটররা বলছে, মোবাইল ব্যবহারে করহার বাড়ানোর কারণে এ খাতে বেশি প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে।
করোনার কারণে ২০২১ অর্থবছরের বড় একটা সময় ব্যাংকিং কার্যক্রম সীমিত ছিল। তারপরও আগের বছরের তুলনায় এ খাত থেকে সরকারের আয় বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। ব্যাংক হিসাব খোলা, ঋণ প্রদান, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ঋণের হিসাব, আমদানি-রপ্তানিসহ ব্যাংকের সব ধরনের সার্ভিস চার্জ থেকে সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট পায়। এ ছাড়া ব্যাংকের কেনাকাটায়ও দিতে হয় উৎসে ভ্যাট।
এনবিআরের তথ্য বলছে, ২০২১ অর্থবছরে ব্যাংকের এসব চার্জের ওপর ২ হাজার ২৫১ কোটি টাকা ভ্যাট পেয়েছে সরকার। আগের বছর এ খাতে আদায়কৃত ভ্যাট ছিল ১ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। করোনাকালে ভালো ব্যবসা করেছে ওষুধশিল্প।
গত বছর করোনার লকডাউনের মধ্যেও সচল ছিল আবাসনসহ নির্মাণ খাত। এ খাতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত কনস্ট্রাকশন ফার্মগুলো থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণ বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। এ খাতের অনুষঙ্গ রড, সিমেন্ট ও সিরামিকস থেকেও রাজস্ব ১০ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে। এনবিআরের তথ্যানুসারে, গত বছর স্টিল ও রডশিল্প থেকে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে ২৭ শতাংশ, সিমেন্ট খাত থেকে ১১ শতাংশ ও সিরামিকস থেকে ৩৬ দশমিক ১৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলালউদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। ব্যবসাবাণিজ্যের স্থানগুলো আবার ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। মানুষ কাজ করছে। তবে মানুষের মনে অজানা একটা আতঙ্ক তো রয়েছেই। যদিও সেটা আগের তুলনায় অনেকটা কম। শিল্প খাতের উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক রয়ে গেছে। বিক্রি তেমনভাবে শুরু না হলেও সব কিছু খুলে গেছে। এটি ইতিবাচক। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিক্রি না থাকলেও মানুষ আসতে শুরু করেছে। সুযোগ পেলে ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি।
অন্যদিকে দেশের শেয়ারবাজার ফিরে পেয়েছে ঊর্ধ্বগতি। সূচকের দাম বৃদ্ধির মধ্য দিয়েই সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ পার করেছে দেশের পুঁজিবাজার। আলোচিত সপ্তাহে পাঁচ কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছে। সপ্তাহের প্রথমদিন রবিবার সূচকের পতন হয়েছিল। পরের চারদিন সূচক বৃদ্ধি হয়েছে। এতে নতুন করে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি বেড়েছে (বাজার মূলধন) সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা।