ডেস্ক নিউজ
সাত বছর আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, রাজধানীতে আর কাউকে প্লট দেওয়া হবে না। ২০১৪ সালে তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এ ঘোষণা দিয়েছিলেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, প্লট যিনি পান, তিনি অত্যন্ত লাভবান হন। কিন্তু বিশালসংখ্যক মানুষের আবাসনের চাহিদা অপূর্ণ থেকে যায়। আগের সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে মন্ত্রী, এমপি, রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও বিত্তশালীদের প্লট দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে রাজউক। এ জন্য বড় আকারের দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি এসেছে। এর একটি মূলত মন্ত্রী-এমপিদের জন্য, অন্যটি বিত্তশালীদের জন্য। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, প্রভাবশালীদের চাপের মুখে এমন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। রাজউক অবশ্য জানিয়েছে, সাধারণ মানুষও সেখানে প্লটের আবেদন করতে পারবেন।
মন্ত্রী-এমপিদের জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে সাভার ও কেরানীগঞ্জের ১৬টি মৌজায়; দুই হাজার ২৮৭ একর জমিতে। এ জন্য এসব মৌজার কয়েক হাজার পরিবারের ভিটেবাড়ি ও স্থাপনা অধিগ্রহণ করা হবে। প্রকল্পটি ২০২২ সালে শুরু করে ২০২৬ সালে শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। আর বিত্তশালীদের জন্য প্রকল্পটি হবে আমিনবাজার থেকে গাজীপুরের কাশিমপুর পর্যন্ত তুরাগ নদের দুই পাড় ঘেঁষে; জলাশয়ভিত্তিক আবাসন প্রকল্প। নাম দেওয়া হয়েছে ‘আশুলিয়া ওয়াটার বেইজড মডেল টাউন’। এ ছাড়া রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলের চেহারার আমূল পরিবর্তন করার জন্য কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর এলাকায় বাস্তবায়ন করা হবে ‘শেখ রাসেল ওয়াটার বেইজড বিনোদন পার্ক’।
তিনটি প্রকল্পেরই সবকিছু চূড়ান্ত করা হয়েছে। শেখ রাসেল ওয়াটার বেইজড পার্কের প্রকল্প পরিচালকও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্য দুটির প্রকল্পপত্রও চূড়ান্ত।
প্রকল্প তিনটি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী সমকালকে বলেন, দুই বছর ধরে দেশে করোনা মহামারি চলছে। এ জন্য কাজ এগোয়নি। এখন দ্রুতই কাজ শুরু হবে।
তিনি জানান, তিনটি প্রকল্পেরই দেখভাল করছেন রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম। এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে বলেন, আশরাফুলই এগুলো সম্পর্কে ভালো জানেন।
আশরাফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, শেখ রাসেল ওয়াটার বেইজড বিনোদন পার্কের কাজটা দ্রুতই শুরু হবে। এ জন্য প্রকল্প পরিচালকও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আশুলিয়ার প্রকল্পটিতে বিদেশি বিনিয়োগকারী পাওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এটার কাজও এখন দ্রুতই এগোবে। আর কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন বাস্তবায়ন করতে হবে রাজউকের নিজস্ব অর্থায়নে। বর্তমানে রাজউকের ফান্ডে অর্থের কিছু ঘাটতি আছে। তবে এটাও দ্রুতই বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে।
মন্ত্রী-এমপিদের জন্য কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন :রাজউক সূত্র জানায়, যেসব এমপি-মন্ত্রী রাজধানীতে প্লট পাননি, বিভিন্ন সময়ে তারা প্লটের জন্য সংসদে সরব হয়েছেন। তাদের চাপে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন নামে একটি প্রকল্পপত্র তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠায় রাজউক। ওই বছরই পূর্ত মন্ত্রণালয় প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, প্রথমে প্রকল্পটি ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পাশে কেরানীগঞ্জে ঝিলমিল-২ আবাসিক প্রকল্প নামে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছিল রাজউক। কিন্তু সেখানে প্রয়োজনীয় জমি না পাওয়ায় পরে একই সড়কের ধলেশ্বরী সেতুসংলগ্ন এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এলাকাটি রাজউকের আওতাধীন না হওয়ায় কেরানীগঞ্জ ও সাভারের ১৬টি মৌজাকে প্রকল্পের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
ওই কর্মকর্তা বলেন, মৌজাগুলোর অবস্থান বসিলার পশ্চিম পাশে। জাতীয় সংসদ ভবন থেকে প্রকল্প এলাকার দূরত্ব ৫-৭ কিলোমিটার। মন্ত্রী-এমপিদের যাতায়াতের সুবিধার কথা চিন্তা করে ওই স্থানটিই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ঘরবাড়ি ও বড় ধরনের অবকাঠামো রয়েছে। এগুলো ভেঙে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের খবর জানাজানি হওয়ায় কিছুদিন আগে এলাকাবাসী আন্দোলনে নামে। পরে রাজউক থেকে আশ্বাস দেওয়া হলে তারা শান্ত হয়। এখন আবার সেই স্থানেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রী-এমপিদের চাপে নেওয়া কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল আলম বলেন, মন্ত্রী-এমপিদের জন্যই যে এ প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, তা ঠিক নয়। সাধারণ মানুষও সেখানে প্লটের আবেদন করতে পারবেন।
তিনি বলেন, সেখানে মানুষের ঘরবাড়ি থাকায় এলাকাবাসী বাধা দেবে কিনা এ জন্য একটু ধীরে চলতে হচ্ছে। মানুষকে বোঝাতে হচ্ছে, প্রকল্পটি হলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, বরং তারা ক্ষতিপূরণ ও প্লটও পাবে।
যেখানে হবে কেরানীগঞ্জ মডেল টাউন :রাজউকের প্রকল্পপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৬টি মৌজায় মোট জমির পরিমাণ দুই হাজার ২৮৭ একর। এখানে আট হাজার প্লট তৈরি করা যাবে। মৌজাগুলো হলো- আহাদিপুর, বড়েকান্দি, বাড়িলগাঁও, বেলতা, দক্ষিণ বাহেরচর, দেওলী কাশারিয়া, নজিপুর, উত্তর বাহেরচর, তারানগর, ছাগলকান্দি, মুন্সিনোদ্দা, চুনারচর, তুরাগ, পাঁচুলী ও ভাকুর্তা।
প্রকল্প এলাকার বেশিরভাগ জমিই তারানগর ইউনিয়নে পড়েছে। কয়েক হাজার পরিবার এ এলাকায় বহুকাল ধরে বসবাস করছে। তারানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ফারুক বলেন, রাজউক ২২-২৩শ একর এলাকায় এটা বাস্তবায়ন করতে চায়। কিন্তু আমরা বলেছি, ৯০০ একরের মধ্যে করতে। এগুলো খালি আছে। বাকি এলাকায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার ঘরবাড়ি রয়েছে। ঘরবাড়ি ভেঙে করলে এলাকাবাসীর আপত্তি আছে। এ জন্য এলাকাবাসী বছর তিনেক আগে আন্দোলনও করেছিল।
রাজউক বলছে, এলাকাবাসী যাতে অসন্তুষ্ট না হয়, সে জন্য তাদের বাজারমূল্যের তিনগুণ ক্ষতিপূরণ ও প্লট দেওয়া হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান সমকালকে বলেন, কেরানীগঞ্জে একটা স্মার্ট সিটি করতে চায় রাজউক। এ নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে রাজউক একটি বৈঠকও করেছিল। তখন পরিকল্পনাবিদরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, যেখানে সরকারের প্রধানমন্ত্রী-পূর্তমন্ত্রী বলেছিলেন আর কোনো প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে না, সেখানে কেন আবার এই উদ্যোগ?
রাজউক একটি ‘স্মার্ট সিটি’ করতে চায় বলে জানান ড. আদিল। তিনি বলেন, ‘আমরা ওই বৈঠকে বলেছি, স্মার্ট সিটি যদি করতেই হয়, তাহলে ঢাকার বাইরে করা উচিত হবে। কারণ সবকিছু ঢাকায় কেন্দ্রীভূত করা ঠিক হবে না।’
জলাশয়ভিত্তিক মডেল টাউন :আমিনবাজার, মিরপুর, সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের কাশিমপুরের অংশবিশেষ নিয়ে একটি বৃহৎ আবাসন প্রকল্প করছে রাজউক। কর্মকর্তারা জানান, তুরাগ নদের পাড় ঘেঁষে সাভার ও আশুলিয়ার বিশাল এলাকা ভূমিদস্যুদের হাত থেকে রাজউক রক্ষা করতে পারছে না। বর্ষা মৌসুমে রাতের বেলায় নৌকায় করে তারা বালু ফেলে। শুস্ক মৌসুম শুরু হতেই সেখানে চর জেগে ওঠে। এভাবে আশুলিয়ার বিশাল এলাকা ইতোমধ্যে ভরাট হয়ে গাছপালা গজিয়েছে। এ জন্যই আমিনবাজার থেকে কাশিমপুর পর্যন্ত পুরো এলাকা অধিগ্রহণ করে তুরাগ নদ ও জলাশয়গুলো রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এ প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে।
প্রকল্পে বলা হয়েছে, যেসব স্থান ভরাট হয়ে গেছে সেখানে প্লট বানিয়ে বরাদ্দ দেওয়া হবে। এরই মধ্যে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংকে (আইডব্লিউএম) দিয়ে ওই এলাকার জরিপও করেছে রাজউক। তাতে দেখা গেছে, সেখানে ৭১ শতাংশ জলাশয় রয়েছে। বাকি ২৯ শতাংশে প্লট, খেলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্র, মার্কেট, হোটেল প্রভৃতি তৈরি করা যাবে। এ ছাড়া জায়গাটি বিমানবন্দরেরও কাছে হওয়ায় আরও আকর্ষণীয় হবে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
গাবতলী ব্রিজের উত্তরে কোর্টবাড়ি মৌজা ও পশ্চিমে আমিনবাজার ল্যান্ডফিল থেকে উত্তর দিকে আশুলিয়া পর্যন্ত তুরাগ নদের দুই পাশ দিয়ে গাজীপুরের কাশিমপুর পর্যন্ত এলাকায় হবে এই আবাসন প্রকল্প। এসব এলাকায় বেশকিছু ঘরবাড়ি, কারখানা, পার্ক, রেস্টুরেন্ট, পিকনিক স্পট, আবাসন প্রকল্পসহ বিভিন্ন ধরনের অবাঠামোও রয়েছে। এসবের প্রায় সবই জলাভূমি ভরাট করে তৈরি হয়েছে বলে রাজউকের কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
মিরপুরের নবাবেরবাগ, দিয়াবাড়ি, সাভারের সাঁতারবাড়ি, চন্দ্রনারায়ণপুর, শিবপুর, কাউন্দিয়া, বাঘসাঁতরা, বনগাঁ, বেরাইদ, গেণ্ডারিয়া, চাকুলিয়া, বিরুলিয়া, আশুলিয়ার দেনুয়া, বিনোদপুর, প্যারাগাঁও, ভাসান, গুশুলিয়া, গুটিয়া, পালাসনা, জিরাবো ও বাসান মৌজায় বাস্তবায়িত হবে আশুলিয়া আবাসন প্রকল্প। জলাশয় ছাড়া ৯ হাজার একরের কিছু বেশি এলাকা নিয়ে এটি হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, জলাশয়গুলো রক্ষা করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে ব্যয় বাড়বে অনেক। এ জন্য সেখানে প্লটের দামও হবে তুলনামূলক বেশি।
আশুলিয়া মডেল টাউন সম্পর্কে নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান সমকালকে বলেন, জলাশয় বা তুরাগ নদ রক্ষা করতে না পেরে যদি সেখানে আবাসন প্রকল্প নেয় রাজউক, তা হবে দুঃখজনক। বছরখানেক আগে এটা নিয়ে রাজউক আমাকে ডেকেছিল। তখন বলেছিলাম, ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরগুলোতে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে। আর জলাশয়কে রক্ষা করতে হবে আলাদাভাবে।
শেখ রাসেল জলাশয়ভিত্তিক বিনোদন পার্ক :১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিশুপুত্র শেখ রাসেলের নামে ‘শেখ রাসেল ওয়াটার বেইজড বিনোদন পার্ক’ নির্মাণ করবে রাজউক। ঘাটারচরের ওই স্থানের বেশিরভাগই জলাশয়। সরকারি খাস হিসেবে চিহ্নিত ওইসব জমির কিছু অংশ দখলদাররা ভরাট করে দখল করে রেখেছে। তাদের উচ্ছেদ করে সেখানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। যেহেতু সেখানে জলাশয় রয়েছে, কাজেই জলাশয়কে রেখেই পরিকল্পনা করা হয়েছে।
মোহাম্মদপুর সংলগ্ন বছিলা ব্রিজ পার হয়ে কিছুদূর এগোলেই ঘাটারচর এলাকা। সেখানেই ৫০ দশমিক ৭০ একর জমির ওপর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে ১০ দশমিক ৭২ একর খাসজমি। বাকিটা আশপাশ থেকে অধিগ্রহণ করা হবে। এ প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় পাঁচশ কোটি টাকা।
সংশ্নিষ্টরা জানান, বিনোদন পার্ককে আকর্ষণীয় করার জন্য সেখানে থাকবে এম্পিথিয়েটার, কমিউনিটি সেন্টার, অফিস ভবন, ওয়াচ টাওয়ার, ব্যায়ামাগার, আধুনিক রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, সাঁতারকাটা নৌকা ভ্রমণসহ জলাশয়কেন্দ্রিক নানা ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষের বনভোজন বা পারিবারিক অনুষ্ঠানের সুযোগ থাকবে।
জানা গেছে, এ জন্য প্রকল্পপত্রে ঘাটারচার মৌজার ১২১, ১৯৭, ৭৩৯, ৫০০, ৫০২, ৫৪৫ ও ৪৯৮ দাগের জমি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো খাসজমি হিসেবে চিহ্নিত। এসব দাগের জমি ড্যাপে হালট, নাল ও বিল হিসেবে চিহ্নিত আছে। এর বাইরে আশপাশ থেকে বাকি জমি অধিগ্রহণ করা হবে, যা ব্যক্তিমালিকানাধীন।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল আলম বলেন, এ প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পথে। খুব শিগগির বিস্তারিত জানা যাবে।