ডেস্ক নিউজ
রপ্তানি আয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। রেকর্ডের পর রেকর্ড হচ্ছে।
গত সেপ্টেম্বরে ৭০০ কোটি (৭ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৫০ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৭০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক মাসে পণ্য আমদানিতে এতো বেশি অর্থ ব্যয় হয়নি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া লেগেছে আমদানির পালে। বাড়ছে ডলারের চাহিদা। এতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে পড়েছে টান। বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম; কমছে টাকার মান।
এর আগে আগস্ট মাসে ৬৫৮ কোটি ৩৩ লাখ (৬.৫৮ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল, যা ছিল এক মাসের হিসাবে এতোদিন সর্বোচ্চ।
আমদানি বাড়াকে দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল বলছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। তবে, রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে রপ্তানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স বাড়ানোর দিকে জোর দিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার আমদানি সংক্রান্ত যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ১ হাজার ৮৭২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই তিন মাসে ১ হাজার ২৬৮ কোটি ৬৫ লাখ (১২.৬৮ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের (২০১৯-২০) জুলাই-সেপ্টেম্বরের চেয়ে ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ কম।
করোনা মহামারির কারণে আমদানি কমে যাওয়ায় গত অর্থবছরের প্রথমার্ধে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় দ্বিতীয়ার্ধে এসে আমদানি বাড়তে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ৬৫ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড আমদানি খরচ নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছর শেষ হয়।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকে বাংলাদেশেও করোনার প্রকোপ স্বাভাবিক হতে শুরু করে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোদমে চালু হয়। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে আমদানি। এখন প্রতি মাসেই রেকর্ড হচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আমদানি বাড়াকে দেশের অর্থনীতির জন্য ‘মঙ্গল’ হিসেবেই দেখছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গত দেড় বছরের বেশি সময় করোনা মহামারির মধ্যেই দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। প্রথম দিকে আমদানি কমলেও পরে বেড়েছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তাই আমদানি বাড়ছে। এটা অর্থনীতির জন্য ভালো।
‘পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেলসহ বড় বড় প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। এ সব প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানিতে মোটা অংকের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়েছে।
‘এসব কারণেই গত অর্থবছরে আমদানি খাতে খরচ প্রথমবারের মতো ৬৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এবার আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।
‘এতে উদ্বেগের কিছু নেই। করোনার পর বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের চাহিদা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। সে কারণে রপ্তানিতেও রেকর্ড হচ্ছে। দেশের ভেতরেও চাহিদা বেড়েছে। সব মিলিয়ে সব খাতে উৎপাদন কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, কাঁচামালসহ সব পণ্যের প্রয়োজন হচ্ছে। সে কারণেই আমদানিতে জোয়ার এসেছে।
‘এখানে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, আমদানি বাড়া মানে বিনিয়োগ বাড়া। বিনিয়োগ বাড়া মানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হওয়া।
‘তবে, আমদানির আড়ালে যাতে এক পণ্যের জায়গায় অন্য পণ্য না আসে, বিদেশে টাকা পাচার না হয়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে।’
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আশার কথা হচ্ছে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে আগামী বছর থেকেই যান চলাচল করবে। মেট্টোরেলও পুরোদমে চালু হবে। কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজও শেষ হবে। এই তিনটি বড় প্রকল্প বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ভিন্নমাত্রা যোগ করবে। আরও কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষ হয়েছে। আরও কয়েকটির কাজ চলছে।
‘সে পরিস্থিতিতে ২০২৩ সাল থেকে অন্য বাংলাদেশ পাবে দেশবাসী। আর এসব উন্নয়নযজ্ঞকে কেন্দ্র করেই বিনিয়োগের ছক কষছেন উদ্যোক্তারা। সে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পণ্য সরঞ্জাম আমদানি করছেন তারা। এতেই বাড়ছে আমদানি।’
তিনি বলেন, ‘স্বস্তির জায়গা হচ্ছে আমাদের রিজার্ভ এখনও সন্তোষজনক অবস্থায় আছে। রপ্তানিও আয় ভালো আসছে। তবে, রেমিট্যান্স কিন্তু অনেক কমে গেছে। যে কোনা কারণে যদি রপ্তানিও কমে যায়, তাহলে কিন্তু রিজার্ভও কমে যাবে। সে কারণে সরকারের এখন রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি রেমিট্যান্স বাড়ানোর দিকেও মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।’
রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘আমাদের রপ্তানির প্রধান বাজার ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মানুষ আগের মতো পোশাক কিনছে। সে কারণে প্রচুর অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের এখানেও করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এতে রপ্তানিসহ অন্যান্য খাতের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিসহ অন্যান্য পণ্যের আমদানি বাড়ছে। তার প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক আমদানিতে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ২০ শতাংশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, এই চার মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ।
এক মাসেই ৬০ হাজার কোটি টাকার আমদানি
রিজার্ভ ৪৬.৫ বিলিয়ন ডলার
রেমিট্যান্স কমায় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভেও প্রভাব পড়েছে। বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি বাড়ার পরও গত ২৪ আগস্ট আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ১৪৪ কোটি ৮০ লাখ (প্রায় ১.৪৫ বিলিয়ন) ডলার এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস) ঋণ রিজার্ভে যোগ হওয়ায় এক লাফে তা বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।
আমদানি বাড়ায় রিজার্ভ থেকে প্রয়োজনীয় ডলার চলে যাওয়ায় এক মাসের ব্যবধানে তা আরও কমে প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়।
রপ্তানি বাড়ায় গত কয়েক দিনে অবশ্য তা কিছুটা বেড়ে ৪৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
তবে, আগামী সপ্তাহে আকুর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের মতো আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।