ডেস্ক নিউজ
মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতির পরিবর্তে কৃষকরা আধুনিক সরঞ্জামাদি দিয়ে কৃষিকাজে উদ্বুদ্ধ হওয়ায় সব ধরনের ফসল উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়েছে। এতে খরচের পাশাপাশি কৃষকের পরিশ্রমও অনেক কমেছে। তবে হতদরিদ্র অনেক কৃষক অর্থাভাবে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে না পারায় এ যাত্রায় তারা এখনো অনেকটা পিছিয়ে। এ সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিপণ্য উৎপাদনে বড় বিপস্নব ঘটাতে সরকার দেশে ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এ টার্গেট বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয়ভাবে ভারী কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির পরিকল্পনা করছে। এসিআই এগ্রি বিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডক্টর এফ এইচ আনসারি বলেন, ‘কৃষি যন্ত্রপাতিতে বাংলাদেশে ৩০ হাজার কোটি টাকার বাজার আছে। কিন্তু বর্তমানে যে পরিমাণ কৃষিযন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে তার বাজার মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকার।’ তিনি আরও বলেন, ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাজার বড় হবে এবং এটি বিনিয়োগের খাত হিসেবে বিবেচিত হবে।’ বর্তমানে এসিআই মটরস, মুন্নু এগ্রোসহ হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি ভারী কৃষিযন্ত্র আমদানি করে। তবে সারাদেশে শতাধিক প্রতিষ্ঠান ছোট ছোট কৃষিযন্ত্র তৈরি করছে। সরকার ভারী কৃষিযন্ত্র যেমন কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, রিপার ও রাইস ট্রান্সপস্ন্যান্টারের মতো যন্ত্রে অঞ্চলভেদে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে। এজন্য ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ বছর মেয়াদি কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ২০২০-২১ সাল থেকে। জানা গেছে, এসিআই মটরস ও আলিম ইন্ডাস্ট্রিজ ভারী কৃষিযন্ত্র আমদানি করছে। এর মধ্যে এসিআই জাপানের ইয়ানমার কোম্পানি থেকে কৃষিযন্ত্রপাতি আমদানি করে। তবে জাপানি এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে দেশে ভারী যন্ত্রপাতি তৈরির পরিকল্পনা করছে এসিআই। এসিআই সূত্রে জানা যায়, ইয়ানমারের সঙ্গে চুক্তির জন্য এসিআই আলোচনা করছে। কারণ বিশ্বব্যপী ইয়ানমার যে ধরনের কৃষিযন্ত্র সরবরাহ করে তা সবগুলো বাংলাদেশের ভূমির প্যাটার্নের কারণে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার উপযোগী নয়। কিছুটা পরিবর্তন এনে এ যন্ত্রগুলো তৈরি করতে হবে। অন্যদিকে যন্ত্রপাতি তৈরির মতো যথেষ্ট প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলও বাংলাদেশে নেই। যন্ত্র তৈরিতে এই কারিগরি সহযোগিতাগুলো ইয়ানমারের কাছ থেকে এসিআই নিতে চায়। বাংলাদেশে শ্রমিকের খরচ কম হওয়ায় ইয়ানমার এ দেশে কারখানা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা এখানে উৎপাদিত কৃষিযন্ত্র বাংলাদেশে চাহিদা মিটিয়ে এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোতে সরবরাহ করতে চায়। তবে কত টাকা বিনিয়োগ করা হবে, কীভাবে জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি তৈরি করা হবে সেগুলো নিয়ে আলোচনা চললেও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তবে এসিআই ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় কারখানা তৈরির জন্য জমি খুঁজছে বলেও জানা গেছে। এসিআই মানিকগঞ্জে হালকা কৃষিযন্ত্র তৈরির জন্য একটি অটোমেটেড কারখানা তৈরি করেছে। ডাচ সরকারের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান, এফএমও, সিঙ্গাপুর ভিত্তিক এসডিআই প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে যৌথভাবে এই প্রকল্পে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এদিকে কৃষি যন্ত্রপাতির সেক্টরে ভালো সম্ভাবনা থাকায় মুন্নু এগ্রো চলতি বছর তাদের পুরনো একটি টুলস ফ্যাক্টরিতে এ বছরই ছোট পরিসরে কৃষিযন্ত্র তৈরি করছে। শস্য মাড়াই যন্ত্র, রিপার ও বীজ বপনের জন্য কৃষিযন্ত্র তৈরি করছে। এই যন্ত্রগুলো তৈরিতে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। প্রতিষ্ঠানটি একটি অত্যাধুনিক কারখানা গড়ে তুলতে চায়। এজন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিক অবস্থায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চায়। খামারবাড়ি কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, গত এক দশকে কৃষিতে যন্ত্রের বহুমুখী ব্যবহার বিপুল হারে বেড়েছে। সেচ যন্ত্রে মোটরের ব্যবহার দিয়ে এর যাত্রা শুরু। চীন থেকে আসা এসব যন্ত্রে কৃষকরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে কৃষি খাতে পাওয়ার টিলারের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে জমি কর্ষণে পাওয়ার টিলারের ব্যবহার হয় প্রায় ৯৫ শতাংশ। গরু দিয়ে হালচাষ করা হয় না বললেই চলে। দেশে ধান রোপণ ও কর্তনে এবং শুকানোতেও নলেজ বেইজ যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ও রোবটের ব্যবহার বাড়ছে। বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আরও নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি যন্ত্রপাতি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএমএমএ) সূত্রে জানা গেছে, দেশের শস্য প্রক্রিয়াকরণে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার প্রায় শতভাগ। দ্রম্নত ফসল ঘরে তুলে ও প্রক্রিয়াজাত করে দুই ফসলের মধ্যবর্তী সময় কমিয়ে আনতে ও উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতেও কৃষক এসব যন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়েছেন। তবে এর বেশির ভাগই আমদানিনির্ভর। স্থানীয়ভাবেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে মাড়াইযন্ত্র, সেচযন্ত্র ছাড়াও বেশ কিছু পাম্প স্থানীয়ভাবে তৈরি করে। আমদানি করা প্রধান যন্ত্রের মধ্যে বড় বাজার দখল করে আছে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর ইঞ্জিন, হারভেস্টার, ট্রান্সপস্ন্যান্টার। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফসল আবাদে চাষ, সেচ, নিড়ানি, কীটনাশক প্রয়োগে ৮০ থেকে ৯৫ শতাংশ যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে। তবে অন্ধকার দিকটা হলো- ফসল রোপণ, সার দেওয়া, কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও শুকানোর ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার ১ শতাংশের কম। কৃষিমন্ত্রী ডক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাক সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘পর্যায়ক্রমে স্থানীয়ভাবে কৃষিযন্ত্র তৈরি করতে চান। বর্তমানে বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তা তারা কমিয়ে আনতে চান। ইতোমধ্যে তিনি ইয়ানমার, টাটাসহ অনেক কোম্পানির সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের অনুরোধ করেছেন যাতে তারা বাংলাদেশে কৃষিযন্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপন করে।’ এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কৃষি যন্ত্রপাতির আধুনিক সরঞ্জাম ডিজেল ইঞ্জিন ও পাওয়ার টিলার আমদানি হয়েছে প্রায় ২ হাজার ২১৯ কোটি টাকার। এর মধ্যে সরকার এ খাতে রাজস্ব পেয়েছে প্রায় ৬৯৫ কোটি টাকা।