ডেস্ক নিউজ
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের কবল থেকে স্বাধীন হয় ফরিদপুরের খলিল মুন্সী তখন ১৮ বছরের এক তরতাজা যুবক। দেশ স্বাধীন হওয়ায় মনে আনন্দ। বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া কিছু জায়গা জমি নিয়ে শুরু হলো বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রাম। পুরোপুরি কৃষি উৎপাদনে জড়িয়ে পড়লেন। এর দশ বছর পর ঘর আলোকিত করে এলো নতুন অতিথি। একটি ছেলে সন্তানের পিতা হলেন তিনি। দ্বিতীয় প্রজন্মের সেই ছোট্ট শিশু হাসান মুন্সী এখন পুরান ঢাকার টিপু সুলতান রোডে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের এক তরুণ উদ্যোক্তা। তার কারখানায় উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি হচ্ছে বিদেশেও। হাসান মুন্সীর মতো বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনের গল্প প্রায় একই সূত্রে গাঁথা।
স্বাধীনতার আগে কৃষি খাতই ছিল এ?দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। এখনও দেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মেটাচ্ছেন কৃষক। এখন তাঁদের সন্তানেরাই শিল্পকারখানায় কাজ করে স্বাধীন দেশটিকে উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন। স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশক ধরে দেশে নীরবে বেসরকারী খাতে শিল্পবিল্পব ঘটে চলেছে। ৩ হাজার থেকে বাড়তে বাড়তে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই সময়ে প্রায় ৮৮ লাখ কারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করা হচ্ছে। এককালের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ ২০৩৫ সালে হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। দেশের কর্মক্ষম সাড়ে ৮ কোটি মানুষের অন্তত ৮০-৮৫ শতাংশেরই জীবিকা জড়িত বেসরকারী খাতের সঙ্গে।
সূত্রমতে, স্বাধীনতার ৫০ বছরে কৃষিনির্ভর থেকে বেরিয়ে পুরোপুরি শিল্পভিত্তিক দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে এর আগে প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন এবং ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসন ও শোষণের ফলে বাংলাদেশে শিল্প খাতে তেমন কোন বিকাশ হয়নি। ব্রিটিশ আমলে এদেশের কাঁচামাল দিয়ে শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছিল ইংল্যান্ডে। পাকিস্তান আমলে যে কয়েকটি কারখানা ছিল তা স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্মম ধ্বংসযজ্ঞে বিনষ্ট হয়ে যায়। দেশের সবচেয়ে বড় জুটমিল আদমজী বন্ধ করে দেয়া হয়। শুধু ব্যাপক উৎপাদনের কারণে স্বাধীনতার আগেই দেশে পাট শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এই পাট নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্রের কারণে সেই ইতিহাসও সমৃদ্ধ নয়। নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে সোনালি আঁশ খ্যাত শুধু পাটই ছিল তখন রফতানিমুখী অর্থকরী ফসল। ১৯৭৩ সালে মোট রফতানির মধ্যে ৫২ শতাংশ পাটজাত পণ্যের দখলে ছিল। এর পাশাপাশি তখন অল্প অল্প করে চা, চিনি, কাগজ এবং চামড়া শিল্প খাতও জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়।
তবে দেশ স্বাধীনের পর শিল্প খাতের বিকাশ হতে শুরু করে। ওই সময়ে বেড়েছে কৃষি উৎপাদনও। ১৯৭২-৮১ সালের মধ্যে সরকার জাতীয়করণ নীতি গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে শিল্প খাত বিকাশে বেসরকারী খাতকে উৎসাহিত করা হয়। সরকারী বিভিন্ন উদ্যোগ ও নীতিগত সহায়তার কারণে বেসরকারী খাতে শিল্পায়নে বিপ্লব ঘটে গেছে। সময়ের বিবর্তনে বেসরকারী খাতের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি, বৃহৎ, এমনকি ভারি শিল্পের বিকাশ ঘটছে বেসরকারী খাতের মাধ্যমেই। শিল্পায়নের সম্ভাবনা অনুমান করতে পেরে সরকার হাতে নিয়েছে ১শ’টি অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজ। মূল লক্ষ্য বিনিয়োগকারী আকর্ষণ ও শিল্পায়নের মাধ্যমে ১ কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। উন্নয়নের তাক লাগানো সব চমকে বাংলাদেশ এখন গোটা বিশ্বের কাছে অনন্য দৃষ্টান্ত। শিল্প-বাণিজ্যসহ সব খাতের ক্রমবর্ধমান বিকাশে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে দেশের অর্থনীতি। দেশ যত উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে ততটাই শিল্প-বাণিজ্যের অবদান বাড়ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে এই খাতের বিকাশ ঘটেছে বহুগুণ। বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের ৪৫টি দেশের মধ্যে সম্পাদিত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। যার আওতায় খাতভিত্তিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে রফতানি বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অগ্রাধিকার মূলক ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
শিল্প খাতমুখী দেশের অর্থনীতি ॥ মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতির খোলনলচে পাল্টে গেছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমশ বেরিয়ে এসে শিল্প ও সেবা খাতমুখী হয়েছে অর্থনীতি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পর্যালোচনা করেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিএনপি) কৃষি খাতের অবদান ছিল ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ। আর শিল্প ও সেবা খাতের অবদান যথাক্রমে মাত্র ৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও ৩৪ শতাংশ। স্বাধীনতার পর বিগত ৪৫ বছরে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলো পাল্টেছে। ক্রমশ শিল্প ও সেবা খাতের বিকাশ হয়েছে, যা অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো বদলে দিয়েছে। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের হিসাবে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তিনটি খাতের মধ্যে কৃষি খাতের অবদান তৃতীয় স্থানে। সেবা খাতের অবদান শীর্ষে। গত অর্থবছরে জিডিপিতে সেবা খাতে অবদান ছিল ৫৩ দশমিক ১২ শতাংশ। আর কৃষি খাতের অবদান কমতে কমতে ১৫ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। শিল্প খাত জোগান দিয়েছে ৩১ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
জানা গেছে, দেশের কর্মক্ষম সাড়ে ৮ কোটি মানুষের অন্তত ৮০-৮৫ শতাংশেরই জীবিকা জড়িত বেসরকারী খাতের সঙ্গে। এখন তৈরি পোশাক থেকে শুরু করে কয়েক হাজার আইটেমের পণ্য রফতানি হচ্ছে বিশ্ব বাজারে। স্বাধীনতার আগে ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে ৩ হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু থাকলেও সুবর্ণজয়ন্তীর এই সময়ে সেখানে প্রায় ৮৮ লাখ কারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করা হচ্ছে। উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী রফতানি হচ্ছে ১৯০টি দেশে। কৃষিভিত্তিক এবং আমাদানিনির্ভর দেশ হতে বাংলাদেশ ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে একটি উৎপাদননির্ভর রফতানিমুখী দেশে পরিণত হয়েছে। শিল্প খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধি সাধিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় তৈরি পোশাক প্রধান খাত, ওষুধ, চামড়া, চামড়াজাতপণ্য, পাদুকা, রাসায়নিক, ইলেক্ট্রনিক্স, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং ও জাহাজ নির্মাণসহ বিভিন্ন খাত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব সংস্থাগুলোর মতে, এককালের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ ২০৩৫ সালে হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ২০১৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানেই কর্মরত আছেন প্রায় ৬০ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী। এর বাইরে কুটির, মাঝারি, বৃহৎ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, শিল্পমালিক, ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজসহ বিভিন্ন শিল্প খাতে মোট আড়াই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। বিবিএসের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সারাদেশে কুটির শিল্পের সংখ্যা ৬৮ লাখ ৪২ হাজার, ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১০ লাখের বেশি, ছোট শিল্প রয়েছে প্রায় ৯ লাখ, মাঝারি শিল্প ৭ হাজার, বৃহৎ শিল্প ৫ হাজার ২৫০টি। সব মিলিয়ে দেশে শিল্পের সংখ্যা প্রায় ৮৮ লাখ। এর পুরোটাই বেসরকারী খাতের হাত ধরে প্রসারিত হয়েছে। এছাড়া শিল্পায়ন বা শিল্প খাতকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচনা করে শিল্পায়নের গতিকে বেগবান করতে ২০১১ সালে ‘শিল্পনীতি-২০১০’ ঘোষণা করা হয়। উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার মূলধারায় নারীদের নিয়ে আসা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ এ নীতির মূল উদ্দেশ্য। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআরইউ) ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি থাকবে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখবে বেসরকারী খাত। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হবে, এই ধারণা সংস্থাটি দিয়ে রেখেছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। করোনার আঘাত খানিকটা থমকে দিলেও সার্বিক চিত্র বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশ সে পথেই হাঁটছে। দেশের প্রধান খাত কৃষি হলেও ক্রমেই অবস্থান পাকাপোক্ত করছে শিল্প খাত।
৭৫ শতাংশ বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ ॥ জানা গেছে, সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বা এফডিআইয়ের ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে ৮ম পঞ্চমবার্ষিক পরিকল্পনায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেসরকারী খাতের ভূমিকা আরও বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বেসরকারী বিনিয়োগের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে মোট বিনিয়োগের ৭৫ শতাংশ। মধ্যমেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর বিষয়ে অধ্যায় ৩-এর আলোচনা অনুযায়ী ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ এফডিআইয়ের বিদ্যমান আন্তঃপ্রবাহ জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ থেকে জিডিপির ৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশে বেসরকারী বিনিয়োগ এফডিআইয়ের অংশ এবং বেসরকারী খাতের মাধ্যমে বিদেশী মুদ্রায় সীমিত বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদের ৩ শতাংশ হতে বৃদ্ধি পেয়ে ৭ শতাংশে এসে দাঁড়াবে। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এটি একটি বড় কৌশলগত রূপান্তর যা বেসরকারী বিনিয়োগ ও রফতানি বৃদ্ধিতে মূল ভূমিকা পালন করবে এবং এভাবে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে বেসরকারী বিনিয়োগের নিষ্প্রভ অবস্থার উন্নয়ন সাধন করবে। এফডিআই দ্রুত প্রবৃদ্ধি এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন, জ্ঞান হস্তান্তর ও দক্ষতার উন্নয়ন প্রক্রিয়া শক্তিশালীকরণে বড় ভূমিকা পালন করবে।
পাট থেকে পোশাক শিল্পের জয়যাত্রা ॥ স্বাধীনতার আগে পাট ছিল দেশের প্রধান রফতানিমুখী খাত। আর এখন পোশাক। এ খাতে মোট রফতানির প্রায় ৮০ ভাগই নিয়ন্ত্রণ করছে। এ খাতে অন্তত সরাসরি ৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। আর ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজসহ প্রায় ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান এ খাতের ওপর নির্ভরশীল, যার পুরোটাই বেসরকারী খাতের ওপর দাঁড়িয়ে। আর কৃষিভিত্তিক শিল্প, রড, সিমেন্ট, বিভিন্ন ধরনের রং, রাসায়নিক, ওষুধ, জাহাজভাঙ্গা ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ বহু শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে সময়ের ব্যবধানে। গত এক দশকে শিল্পায়নে বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ বেড়েছে কয়েক গুণ। বেড়েছে কর্মসংস্থান। ফলে আমূল পরিবর্তন এসেছে রফতানি খাতে। গত এক দশকে রফতানি আয় বেড়েছে কয়েক গুণ। সরকারী সংস্থা বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটির (বেজা) তত্ত্বাবধানে সারাদেশে গড়ে উঠছে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল। শুধু চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে ৩০ হাজার একরের বেশি জায়গাজুড়ে গড়ে উঠছে সুপরিকল্পিত বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী। ২০৩০ সালের মধ্যে এটির কাজ শেষ হবে। এক সময়ের কৃষিপ্রধান দেশ হতে যাচ্ছে শিল্পসমৃদ্ধ। এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, স্বাধীনতান সময় মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৩ ডলার। এখন তা ২ হাজার ডলারের ওপরে। কৃষিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে শিল্পনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে সরকারের সহায়তায় বেসরকারী খাতের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিডিপিতে শিল্পের অবদান প্রতিনিয়তই বাড়ছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয়, শিল্পসমৃদ্ধ দেশ গঠনের মাধ্যমে বাঙালী জাতির সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করা যায়। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালে অর্থনীতি বা জিএনপির আকার ছিল মাত্র ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার। তৎকালীন সময়ে মুদ্রা বিনিময় হার ছিল প্রতি ডলারে ৭ টাকা ২৮ পয়সা। সেই হিসাবে, অর্থনীতির আকার দাঁড়ায় ৩ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরে স্থিরমূল্যে দেশের অর্থনীতি বা জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। শিল্প খাতের অবদান কয়েক গুণ বেড়েছে। শিল্প বিপ্লবের ৮০ বছরে ইংল্যান্ড জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ২০ শতাংশ থেকে ৩৩ শতাংশে উন্নীত করেছিল। সেই হিসাবে বলা যায়, বাংলাদেশেও একটি ছোটখাটো শিল্পবিপ্লব হয়েছে।
শিল্পায়নে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে ॥ বেসরকারী খাতের শিল্পায়নে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। শ্রমিকের কারিগরি জ্ঞানের অভাব, খনিজ ও শক্তি সম্পদের অভাব, বৈদেশিক সাহায্যের অভাব, শিল্প ঋণের অভাব, সুষ্ঠু পরিকল্পনা, শিক্ষার অভাব প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের শিল্প নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের জন্য শিল্পায়নের বিকল্প নেই। শিল্পায়নের ফলে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হয়। বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে বিদ্যুত ও জ্বালানি অন্যতম। বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতকে উৎপাদনের প্রাণশক্তি বলা হয়। তাই এ খাতের উন্নয়ন জরুরী। তাছাড়া কারিগরি জ্ঞানে জনশক্তির জন্য কারিগরি বিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও কৃষি কলেজ স্থাপন করা প্রয়োজন।
এছাড়া বেসরকারী উদ্যোক্তাদের ঋণের ব্যবস্থা, অবকাঠামোর উন্নয়ন, পরিকল্পিত শিল্পায়ন, বিদেশে বাজার সৃষ্টি, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে বাংলাদেশে শিল্পায়নের পথ প্রশস্ত হবে। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শিল্প সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। শিল্প ব্যবস্থার উন্নতি হলে দেশের সামগ্রিক অবস্থার উন্নয়ন সাধিত হবে। শিল্প সমস্যা দূরীকরণের মাধ্যমে টেকসই শিল্প ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। এতে শিল্প কাঠামো স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপ লাভ করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ১৭ কোটি মানুষের দেশে শিল্পোন্নয়নের, বিশেষ করে এসএমই খাতের উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। কারণ কৃষি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। দেশে খাদ্য শস্যের উৎপাদন বাড়লেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জমির অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে কৃষি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। অপরদিকে শিল্প খাতে বিনিয়োগ, উৎপাদন, আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা।