ডেস্ক নিউজ
বিজয়ের ৫০ বছরে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জন কী? নিঃসন্দেহে এই প্রশ্নের উত্তরে শীর্ষ যেই বিষয়গুলো আসবে তার মধ্যে অন্যতম দেশের প্রযুক্তি খাত। এখান থেকে এক যুগ আগেও যে বিষয়গুলো নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল আজ তা বাস্তবতা। প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের এই অসাধারণ অর্জন অবশ্য বেশিদিনের নয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সোনার বাংলা’ নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে মূল কাজ শুরু করে ১৯৭২ সালের শেষ ভাগ থেকে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন ছিল তার প্রধান লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ১৫টি সংস্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই আর্থ-সামাজিক জরিপ, আবহাওয়ার তথ্য আদান-প্রদানে আর্থ-রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম বাস্তবায়িত হয়। বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইটের আর্থ স্টেশনও বঙ্গবন্ধুর হাতে উদ্বোধন হয় ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই নেতা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গুরুত্বের কথা বিবেচনায় এনেই কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব প্রদান করেন।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে তথ্য-প্রযুক্তি খাত হয়তো আরও উন্নত হতো, যদি বিনা অর্থে ইন্টারনেট কেবল লাইন যুক্ত করতে রাজি হতো তৎকালীন সরকার। অবশ্য বিগত ১২ বছর তথ্য-প্রযুক্তি খাত সেই ক্ষত কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরবর্তীতে এই কাজের গতি মন্থর হলেও বিগত ১২ বছরে দেশে ৩৯টি হাইটেক পার্ক নির্মিত হয়।
২০১০ সালে ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণ পাচ্ছে আজ সারা দেশের মানুষ। করোনাকালে দেশের কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, দক্ষতা, উন্নয়ন, কর্মসংস্থানসহ এমন কোনো খাত নেই যেখানে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার হয়নি। এক যুগ আগে ‘হোম অফিস’-এর চিন্তা-ভাবনাকেও বাতুলতা মনে হয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালে সারা দেশের জন্য তা ছিল বাস্তবতা। এই বাস্তবায়ন সম্ভব হয় দেশের আইসিটি অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে।
এই ৫০ বছরে আইসিটি খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জনের একটি বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণ। এর মাধ্যমে তথ্য-প্রযুক্তির এক নবদুয়ার উন্মোচিত হয়েছে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে।
একসময় ১ এমবিপিএস ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের খরচ ছিল ৭৮ হাজার টাকা। বর্তমানে তা ৩০০ টাকাতেও মিলছে। মুঠোফোনের কলরেট একসময় ৩০ টাকা করে ছিল প্রতি মিনিট। আজ তা ৬০ পয়সাতেও কল করা যাচ্ছে বিভিন্ন অপারেটরের অফার ব্যবহার করে। শুধু তাই নয়, আইসিটি খাতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্য নিয়ে তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কৃতি ও কাঠামো নির্মাণে হ্রাস করা হয় কম্পিউটার আমদানি শুল্ক। এ ছাড়া হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার শিল্প উৎপাদনকারীদের ভর্তুকি, প্রণোদনা প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
২০১০ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়নে একযোগে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র উদ্বোধন করেন। প্রথমে কেবল ইউনিয়ন পরিষদকেন্দ্রিক এর কার্যক্রম চালু হলেও বর্তমানে পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, গার্মেন্টসকর্মী এবং প্রবাসী নাগরিকদের জন্য আলাদা ডিজিটাল সেন্টার চালু হয়েছে। বর্তমানে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) নামে সুপরিচিত এই সেন্টারগুলো থেকে সারা দেশে ৮ হাজার ২৮০টি ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে ৩০০-এর অধিক ধরনের সরকারি-বেসরকারি সেবা জনগণ গ্রহণ করতে পারছেন। ২০২৫ সাল নাগাদ যখন শতভাগ সরকারি সেবা অনলাইনে পাওয়া যাবে, তখন নাগরিকদের সময়, খরচ ও যাতায়াত সাশ্রয়ের পরিমাণ কী পরিমাণ বাড়বে, তা সহজেই অনুমেয়। ই-নথিতে ১ কোটি ৬৭ লাখ ফাইলের নিষ্পত্তি হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৪৭ লাখ ৭১ হাজারের অধিক ই-মিউটেশন সম্পন্ন হয়েছে অনলাইনে। ‘ফোর টায়ার ন্যাশনাল ডেটা সেন্টার’ প্রকল্পের আওতায় দেশে একটি সমন্বিত ও বিশ^মানের ডেটা সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে।
স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিকাশে আইডিয়া প্রকল্প ও স্টার্টআপ বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডসহ সরকারের নানা উদ্যোগে ভালো সুফল পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে। ই-গভর্নমেন্ট কার্যক্রমে বাংলাদেশকে প্রায় দুইশ বছর ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের প্রচলিত সেবা প্রদানের পদ্ধতির ডিজিটালাইজেশন করা হয়। ৫২ হাজারেরও বেশি ওয়েবসাইটের জাতীয় তথ্য বাতায়নে যুক্ত রয়েছে ৯৫ লাখেরও অধিক বিষয়ভিত্তিক কনটেন্ট এবং ৬৮৫টির বেশি ই-সেবা সহজেই মানুষ অনলাইনে পাচ্ছেন। ৮ হাজার ২৮০টি ডিজিটাল সেন্টার থেকে ৬০ কোটির অধিক এবং জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩-এর মাধ্যমে ৭ কোটির বেশি সেবা দেওয়া হয়। ডিজিটাল সেন্টার, জাতীয় তথ্য বাতায়ন ও মাইগভ থেকে প্রতি মাসে সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা ৭৫ লাখ।
দেশে বর্তমানে মুঠোফোন সংযোগের সংখ্যা ১৮ কোটির অধিক। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বর্তমানে প্রায় ১৩ কোটি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) প্রতিবেদনে যথার্থভাবেই মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় আর্থ-সামাজিক ব্যবধান কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। বিশ্বের ১৯৪টি দেশের সাইবার নিরাপত্তায় গৃহীত আইনি ব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, সাংগঠনিক ব্যবস্থা, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা সূচকে বাংলাদেশ আইটিইউতে ৫৩তম স্থানে এবং এনসিএসআই বা জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা সূচকে ৩৭তম স্থানে অবস্থান করছে। যার ফলে দক্ষিণ এশিয়া ও সার্ক দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।
ডিজিটাল অর্থনীতিতে বাংলাদেশের সাফল্যও বেশ ঈর্ষণীয়। আইসিটি রফতানি ২০১৮ সালেই ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। বর্তমানে আইসিটি খাতে রফতানি ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সারের আউটসোর্সিং খাত থেকে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। ৩৯টি হাইটেক বা আইটি পার্কের মধ্যে ইতোমধ্যে নির্মিত ৯টিতে দেশি-বিদেশি ১৬৬টি প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে। এতে বিনিয়োগ ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং কর্মসংস্থান হয়েছে ২১ হাজার, মানবসম্পদ উন্নয়ন হয়েছে ৩২ হাজার। নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ১০ হাজার ৫০০ নারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর ২০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের আরেকটি বড় অর্জন তথ্য-প্রযুক্তি খাতের বিভিন্ন পণ্য নিজ দেশে উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি। বর্তমানে দেশে হাইটেক পার্কসহ বিভিন্ন স্থানে স্যামসাং, ওয়ালটন, সিম্ফনি, মাই ফোন, শাওমিসহ দেশি-বিদেশি ১৪টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে মুঠোফোন ও ল্যাপটপ উৎপাদন করছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে এবং দেশের মুঠোফোন চাহিদার ৭০ শতাংশ পূরণ করছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো।