ডেস্ক নিউজ
দেশের সর্ব দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালী। এক সময় এই জেলার অর্থনীতি কৃষি ও মৎস্যনির্ভর হলেও দিন দিন শিল্পনির্ভর অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এজন্য প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে পায়রা তাপবিদু্যৎ কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং পায়রা সেতুর মতো মেগা সব প্রকল্পের। গত এক দশকে তিনটি বৃহৎ উন্নয়ন কমকান্ড পুরো জেলার চিত্র পাল্টে দিয়েছে। আর সে কারণেই এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ‘পায়রা’ শব্দটি একটি প্রাণ সঞ্চার জাগানো শব্দ।
পটুয়াখালী জেলার নাম শুনলেই এক সময় ঝড় জলোচ্ছ্বাসের কথা মনে পরত। তবে সেই পরিস্থিতির এখন আমূল পরিবর্তন ঘঠেছে। পটুয়াখালীর নাম শুনলেই সবার কাছে এখন পায়রা সমুদ্রবন্দর, পায়রা তাপ বিদু্যৎ কেন্দ্র কিংবা দৃষ্টিনন্দন পায়রা (লেবুখালী) সেতুর কথা মনে পড়বে। আর দক্ষিণ অঞ্চলের এসব মেগা প্রকল্পের নামকরণ এবং উন্নয়ন অগ্রাধিকারে রয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম। প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্প তিনি নিজে যেমন ভিত্তিপ্রস্তর করেছেন ঠিক তেমনি এগুলোর উদ্বোধনও করছেন নিজ হাতে। আর সর্বশেষ আজ সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদু্যৎ কেন্দ্রের।
পায়রা তাপবিদু্যৎ কেন্দ্র : পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় ধানখালীতে প্রায় এক হাজার একর জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেঘা ওয়াট তাপবিদু্যৎ কেন্দ্র। তাপবিদু্যৎ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক শাহ আব্দুল মওলা জানান, ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নির্মাণাধীন পায়রা ১৩২০ মেঘাওয়াট তাপবিদুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আর ২০২০ সালের ১৫ মে থেকে পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদু্যৎ কেন্দ্রের ১ম ইউনিট উৎপাদন শুরু করে এবং ওই বছরের ডিসেম্বরে দুটি ইউনিটে মোট ১৩২০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদনের স্বক্ষমতা লাভ করে। অন্যদিকে পায়রা বিদু্যৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ফেইজে আরও ১৩২০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। আশা করা যাচ্ছে, যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বর নাগাদ শেষ হবে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২১ মার্চ পায়রা তাপবিদু্যৎ কেন্দ্রের শুভ উদ্বোধন করবেন। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ মালিকানায় তৈরি এই বিদু্যৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২.৪৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় নির্ধারণ করলেও কাজ শেষে প্রায় ১শ মিলিয়ন ডলারের মতো কম ব্যয় হয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদু্যৎ কেন্দ্রে জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত ১৩০ পরিবারের জন্য নির্মিত আবাসন প্রকল্প ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ উদ্বোধন করেছিলেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত ১৩০ পরিবারের মধ্যে বাড়ির চাবি হস্তান্তর করেন।
পায়রা সেতু : এক সময় ঢাকা থেকে পটুয়াখালী এবং কুয়াকাটা পৌঁছোতে বেশকিছু ফেরি পার হতে হতো। তবে সেসব এখন অতীত, সর্বশেষ পায়রা (লেবুখালী) সেতু নির্মাণ করায় এখন ঢাকা-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কে পদ্মা নদী ছাড়া অন্য কোনো ফেরি পাড় হতে হয় না। এতদিন লেবুখালী ফেরিঘাট ছিল একটি বিরম্বনার স্থান, তবে সেতু নির্মাণ করায় সেই এলাকা এখন সমৃদ্ধ জনপথ এবং ভ্রমণের স্থানে পরিণত হয়েছে।
পায়রা (লেবুখালী) সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০২১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনাফারেন্সের মাধ্যমে লেবুখালী পায়রা সেতু উদ্বোধনের পর সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রী পটুয়াখালীর লেবুখালীতে এসে পায়রা নদীর ওপর নির্মিত এ সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট, ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ বিনিয়োগে ১১৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটি নির্মাণ করা হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘লনজিয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ কনেস্টাকশন’র নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছে। ১৪৭০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৯.৭৬ মিটার প্রস্তের এই ব্রিজটি ক্যাবল দিয়ে দুই পাশে সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে নদীর মাঝখানে একটি মাত্র পিলার ব্যবহার করা হয়েছে। আর পিলারের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়েছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর ব্রিজের আদলে নির্মিত দেশের ২য় তম ব্রিজ যা এক্সট্রা ডোজ ক্যাবেল সিস্টেম এ তৈরি করা।
পায়রা সমুদ্র বন্দর : কৃষি ও মৎস্যনির্ভর কলাপাড়া উপজেলায় কলাপাড়া বর্তমানে বাণিজ্যিক উপজেলায় পরিণত হয়েছে। কারণ এ উপজেলায় নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের তৃতীয় পায়রা সমুদ্রবন্দর। ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বন্দরের ফলক উন্মোচন করেন। আর ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পায়রা বন্দরের আনুষ্ঠানিক পণ্য খালাস কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। সে সময় ৫৩ হাজার টন পাথর নিয়ে ফরচুন বার্ড নামে একটি চীনা জাহাজ প্রথম পায়রা বন্দরে বহিঃনোঙ্গর করে। আর সেই থেকে নিয়মিত বহিঃনোঙ্গরে পণ্য খালাস কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই বন্দর ব্যবহার করে আমদানি করা পাথর ব্যবহার হয় পদ্মা সেতুর নির্মাণে। বর্তমানে রামনাবাদ চ্যানেলে প্রায় ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ পায়রা সমুদ্রবন্দরের জেটিসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলছে। আর বন্দরকে কেন্দ্র করে সরকারি বেসরকারি বিনিয়োগে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে কাজ করছেন অনেকেই। আর বর্তমানে এই বন্দর ব্যবহার করে নিয়মিত পায়রা তাপবিদু্যৎ কেন্দ্রে কয়লা আমদানি করা হচ্ছে।
পটুয়াখালীসহ দক্ষিণ অঞ্চলের সামগ্রিক এসব উন্নয়নে জেলার সার্বিক চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। কুয়াকাটায় এখন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণা বেড়েছে। ব্যবসায়িক কাজে পায়রা বন্দর কিংবা সমুদ্রবন্দরে এসে অনেকেই কুয়াকাটায় অবকাশ যাপন করছেন।
পটুয়াখালী চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ও পটুয়াখালী পৌর সভার মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘আমাদের অনেক ব্যবসায়িক বন্ধুরা এই এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং মিল কারখানা গতে তুলতে চাচ্ছেন। অনেকেই জমি কিনে তা ডেভেলপ করছেন। পাশপাশি পটুয়াখালীর আউলিয়াপুরে তৈরি হচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। সব মিলিয়ে আগামী কয়েক বছরে এই জেলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অনেক জেলাকে ছাড়িয়ে যাবে।’
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই জেলার উন্নয়ন সবার কাছে চোখে পড়ার মতো। পটুয়াখালী হবে উন্নয়নের হাব। আগামী ২১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী এই জেলার কলাপাড়া উপজেলার ধানখালীতে পায়রা তাপবিদু্যৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করবেন। শিল্প বিপস্নবের জন্য প্রয়োজন জ্বালানি এসব বিদু্যৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে নিরবচ্ছিন্ন বিদু্যৎ সরবরাহ নিশ্চিত হবে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে দেশি-বিদেশি অতিথিরা থাকবেন, তারা দেখবে কিভাবে একটি জেলা উন্নয়নে নেতৃত্ব দেয়। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের তৃতীয় বাণিজ্যিক জেলা হবে পটুয়াখালী।’