ডেস্ক নিউজ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সাম্প্রতিক উন্নয়ন, অগ্রগতিকে ‘আলোর পথে যাত্রা’ আখ্যায়িত করে একে অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, সমগ্র জাতির কাছে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে আমার আহ্বান ও অনুরোধ থাকবে, আমাদের সকলের প্রচেষ্টায় স্বাধীন করা এদেশকে আমরা এমনভাবে গড়ে তুলব যাতে বাঙালী জাতিকে আর বিশ্বের কারো কাছে মাথা নত করে চলতে না হয়। মাথা উঁচু করেই বিশ্ব দরবারে আমরা এগিয়ে যাব। আলোর পথে এই যাত্রা অব্যাহত থাক, বাংলাদেশের মানুষ সুখী, সমৃদ্ধ এবং উন্নত জীবন লাভ করুক, এটাই আমরা চাই।
বৃহস্পতিবার নয় বিশিষ্ট ব্যক্তি ও দুটি প্রতিষ্ঠানের মাঝে দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় বেসামরিক সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২২’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় আমরা যে এগিয়ে যাচ্ছি, সে যাত্রা যেন অব্যাহত থাকে। দেশ ও মানুষের কল্যাণে যারা আড়ালে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন, কখনও নিজেকে প্রকাশ্যে আনেন না, তাঁদের খুঁজে বের করে পুরস্কৃত করার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, যে জাতি নিজের মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দেয়, স্বাধীনতার জন্য বুকের রক্ত দিয়ে যায়, সে দেশের মানুষকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারে না। সে কথা বলে গেছেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে, আমিও তা বিশ্বাস করি। যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি তা ধরে রেখে এর সুফলটা আমরা প্রত্যেক ঘরে পৌঁছে দেব, এটাই আমাদের লক্ষ্য এবং সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২২ বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, আমাদের দেশের আনাচেকানাচে অনেক মানুষ ছড়িয়ে আছে যাঁরা মানুষের সেবা করেন নিজেদের উদ্যোগে। সেই ধরনের মানুষকেও আমাদের খুঁজে বের করতে হবে এবং তাঁদেরকেও পুরস্কৃত করতে হবে। তিনি বলেন, যাঁরা মানুষের কল্যাণে এবং দেশের উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছেন এমন অনেকেই রয়েছেন যাঁরা কখনও প্রচারে আসেন না। তাঁরা দৃষ্টি সীমার বাইরেই থাকেন। কিন্তু তাঁদেরকে খুঁজে বের করে তাঁদেরকে আমাদের পুরস্কৃত করা উচিত এ কারণে যেÑ তাঁদের দেখে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং অন্যরা শিক্ষা লাভ করতে পারে। মানুষের সেবার মধ্যদিয়ে, মানুষের কল্যাণের মধ্যদিয়ে যে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায় হাজার ধনসম্পদ বানালেও সেটা হয় না। কাজেই সেভাবেই আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকারপ্রধান তাঁর তেজগাঁওয়ের কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত থেকে এ পুরস্কার বিতরণ করেন। তিনি করোনাকালীন অবস্থার উত্তরণে সশরীরে স্বাধীনতা পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারায় নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান এবং সম্মনিত বোধ করছেন বলেও জানান। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চ থেকে নেমে এসে জীবিত দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুদ্দীন আহমেদ ও আবদুল জলিলের হাতে স্বাধীনতা পুরস্কার তুলে দেন।
এ সময় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসলে করোনার সময় তো এক রকম বন্দীখানায় ছিলাম। আজকে আমার ইচ্ছে ছিল এখানে এসে নিজের হাতে পুরস্কার তুলে দেব। স্বাধীনতা পুরস্কার; এটা তো একবারও দিতে পারিনি। কিন্তু বারবার তো এভাবে নিজেকে বঞ্চিত করতে পারি না। আমি মনে করি যে, এটা আমার জন্য অনেক সম্মানের অন্তত পুরস্কারটা হাতে তুলে দিতে পারছি।
এ ছাড়া স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য এবার বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী (মরণোত্তর), শহীদ কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা (বীরবিক্রম) ছাড়াও বর্তমান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের পিতা মোহাম্মদ ছহিউদ্দিন বিশ্বাস এবং বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের পিতা প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক (মরণোত্তর) ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ’ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছেন। ‘চিকিৎসাবিদ্যায়’ পুরস্কার পেয়েছেন অধ্যাপক ডাঃ কনক কান্তি বড়ুয়া ও অধ্যাপক ডাঃ মোঃ কামরুল ইসলাম এবং ‘স্থাপত্য’ ক্যাটাগরিতে প্রয়াত স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেন স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়া ‘মুজিববর্ষে’ বাংলাদেশকে শতভাগ বিদ্যুতায়নে সাফল্যের জন্য বিদ্যুত বিভাগকে এবং বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটকে ‘গবেষণা ও প্রশিক্ষণ’ বিভাগে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রত্যেক পুরস্কার প্রাপ্তকে একটি স্বর্ণপদক, একটি সার্টিফিকেট এবং একটি সম্মানী চেক প্রদান করা হয়।
অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন এবং ‘স্বাধীনতা পুরস্কার পদক-২০২২’ বিজয়ীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী পড়ে শোনান। অনুষ্ঠানে পুরস্কার বিজয়ীদের পক্ষে অধ্যাপক ডাঃ কনক কান্তি বড়ুয়া নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তৃতা করেন।
গত ১৫ মার্চ জাতীয় পর্যায়ে গৌরবময় ও অসাধারণ অবদানের জন্য ১০ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২২’-এর জন্য চূড়ান্ত করে সরকার। পরবর্তীতে সাহিত্য ক্যাটাগরিতে পুরস্কারের জন্য মনোনীত আমির হামজার নাম বিতর্কের কারণে বাদ দেয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনতে এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য বুধবার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২২’-এর জন্য বিদ্যুত বিভাগের নাম মনোনীত করা হয়েছে। ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতিবছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এই পুরস্কার দিয়ে আসছে সরকার ।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ^ অর্থনীতির মন্দাভাব এবং দেশে দেশে খাদ্য সঙ্কট থাকলেও দেশে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পারায় তাঁর সরকারের সাফল্যের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তাঁর দেশে বেসরকারী খাতে গণমাধ্যমকে ছেড়ে দেয়ার কারণে অবাধ স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে অনেক ছোটখাটো বিষয়ও সামনে চলে আসে কিন্তু বিশে^র অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য সঙ্কটের যে বিষয় রয়েছে তা তারা প্রচার করে না।
তিনি বলেন, প্রচার না করলেও আমরা জানি অনেক উন্নত দেশে ব্যাপকভাবে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। এমনকি যারা সারাবিশে^ মোড়লগিরি করে বেড়ায় তাদেরও অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। কিন্তু সেদিক থেকে বিবেচনা করলে করোনা মোকাবেলা করেও বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিধারাটা আমরা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছি। এজন্য তাঁর সহকর্মী এবং সংশ্লিষ্টদের দিন-রাত পরিশ্রমের উল্লেখ করে তাঁদের তিনি আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। পাশাপাশি অকুণ্ঠ সমর্থনের জন্য তিনি তাঁর দলসহ সকল সহযোগী সংগঠন এবং দেশবাসীকেও কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, সরকারী লোকেরা যেমন করেছে তেমনি আমার দলের লোকেরাও আন্তরিকতা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং সহযোগিতা করেছে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা আমাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তা অর্জনের মাধ্যমে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র দিয়েছেন বলেই আজকে আমরা দেশের মেধাবীদের অন্বেষণের সুযোগ পাচ্ছি এবং তাঁদেরকে পুরস্কৃত করে আগামী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করার একটি পদক্ষেপ নিতে পারছি। স্বাধীনতা অর্জন করতে না পারলে মেধা বিকাশের কোন সুযোগ কখনই আমরা পেতাম না বরং শোষিত-বঞ্চিতই থেকে যেতাম।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মিত্র ভারতীয় বাহিনীর আত্মত্যাগ, ভারত সরকার এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সহযোগিতার কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মতো মিত্রবাহিনী এদেশে অবস্থান না করে দেশে ফিরে যাওয়ায় জাতির পিতার কূটনৈতিক সাফল্যের কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন তিনি।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধি ভারতীয় সেনাবাহিনী নিজের দেশে ফেরত নিয়ে যান। যেটা সমসাময়িক ইতিহাসে একটা বিরল ঘটনা। কেননা, জাতির পিতা ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা নেতা, সেই সঙ্গে আমি বলব, ইন্দিরা গান্ধিও ছিলেন স্বাধীনচেতা। যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় শুধু সহযোগিতাই দেননি দেশ পুনর্গঠনে অনেক সহযোগিতাও করে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা একটা ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে দেশকে পুনর্গঠনের পাশাপাশি জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও সে সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নেন। দেশে-বিদেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের ষড়যন্ত্র এবং বৈশি^ক মন্দার মধ্যেও ’৭৫ সালে আমরা ৭ ভাগের উপরে জিডিপি অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিলাম। সে সময়ই বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদাও এনে দেন জাতির পিতা।
শেখ হাসিনা বলেন, ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে গণমানুষের শাসন ব্যবস্থা কায়েম এবং তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত যেন তা পৌঁছাতে পারে সেই পদক্ষেপ জাতির পিতা নেন এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী হাতে নেন। পাশাপাশি সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন। কিন্তু ’৭৫’র ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেট শুধু যে জাতির পিতাকেই সপরিবারে হত্যা করে তা নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যত এবং আলোর পথের যাত্রাকেও অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। ইতিহাস বিকৃতির প্রচেষ্টাও চালানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই সে ইতিহাসকে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, যে ভাষণ দেশে বাজানো নিষিদ্ধ ছিল তা বিশ^ ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিলে স্থান করে নেয়, যে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনে। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং দেশকে তথ্যপ্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করে ডিজিটালাইজড করার পাশাপাশি আজকে শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে প্রত্যেক ঘরে বিদ্যুতের আলো জ¦ালতে সক্ষম হয়েছে।