ডেস্ক নিউজ
সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর আওতায় বাড়ি ও জমি পাওয়া গৃহহীন পরিবারগুলো এখন আত্মবিশ্বাসী। জীবনযুদ্ধে এখন তারা স্বনির্ভর হতে চায়। মাথা গোঁজার ঠাঁই নিশ্চিত হওয়ার পর জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করছে তারা। হাঁস, মুরগি, গরু, মহিষ পালন, সেলাই মেশিন চালানো, মুদি দোকান দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে এসব মানুষ।
সরেজমিন রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জের সাতটি আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকা ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পে যারা বাড়ি পেয়েছে, তাদের কেউ ছিল রেললাইনের পাশে, কেউ শহর রক্ষা বাঁধের ওপর, কেউ মহাসড়কের ধারে ঝুপড়ি ঘরে কোনো রকমে জীবন কাটাচ্ছিল। আশ্রয়ণ প্রকল্পে নিজের বাড়ি ও জায়গা পেয়ে তাদের ভাসমান জীবনের অবসান হয়েছে।
গত শুক্রবার সকালে সিরাজগঞ্জ সদরের খোকশাবাড়ী ইউনিয়নের আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা সীমা বেগমের সঙ্গে কথা হয় কালের কণ্ঠের। আগে সীমা বেগম থাকতেন রাস্তার পাশে ঝুপড়ি ঘরে। আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পেয়ে তিনি ছোট একটা দোকান চালাচ্ছেন। সেখানে লুঙ্গি, গামছা, শাড়ি, চুড়ি, গয়না আর শিশুদের খেলনাসহ নানা জিনিস বিক্রি করে ভালোই আয় করছেন।
সীমা বেগম বলেন, ‘আগে বৃষ্টি হলেই ঘরে পানি ঢুকে পড়ত। বিছানা, জিনিসপত্র ভিজে যেত। ঘুমাতে পারতাম না। ঝড় শুরু হলে তো মনে হতো এই বুঝি আমার ঘরটা উড়ে যাবে। এখন অনেক শান্তিতে আছি। আমি রোজগার করছি, আমার স্বামী ভ্যান চালিয়ে ৪০০-৫০০ টাকা রোজগার করেন। ’
সাত একর জায়গায় খোকশাবাড়ীর এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২৬৬টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার বাড়ি পাবে। প্রথম পর্যায়ে ১০০ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ১২০টি বাড়ি নির্মাণ করে হস্তান্তর করা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে নির্মাণ করা হবে ৪৪টি বাড়ি। এর মধ্যে ২১টি নির্মাণ করা হয়েছে এবং ২৩টি নির্মাণাধীন। প্রকল্পটিতে নির্মাণ করা হয়েছে বৃহদাকার মসজিদ, খেলার মাঠ ও বসার ছাউনি। প্রকল্পটির পশ্চিম পাশ দিয়ে চলে গেছে মহাসড়ক। প্রকল্প এলাকার আধা কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ সরকারি পলিটেকনিক, কয়েকটি সরকারি অফিস ও হাসপাতাল। ফলে এখানকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন সহজ হবে বলে মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফারুক আহাম্মদ বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে থাকা ১০ একর সরকারি খাসজমি দখলমুক্ত করে সাত একরে আশ্রয়ণ প্রকল্পটি করা হয়েছে। বাকি তিন একরে উপকারভোগীদের সুবিধার্থে খোকশাবাড়ী ইউনিয়ন ভূমি অফিসসহ রাইফেল ক্লাব নির্মাণের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। ফলে এই আশ্রয়ণ প্রকল্প ও আশপাশের এলাকা অল্প সময়ের মধ্যেই আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
গত বৃহস্পতিবার রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের রানীনগর গড়বাড়ী গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা নাইম সুলতানার (৩০) সঙ্গে কথা হয়। তিনি হাসি মুখে এই প্রতিবেদককে নিজের ঘরে বসার আমন্ত্রণ জানালেন। ঘরে ঢুকতেই দেখা মিলল তাঁর বৃদ্ধা মা শামসুন্নাহার (৬৫) এবং মেয়ে হুমায়ারার (১১)। রঙিন টিভিতে সিনেমা দেখছিলেন নানি-নাতনি।
নাইম সুলতানা বললেন, ‘কিছুদিন আগেও আমার জীবন এ রকম ছিল না। মেয়ে যখন ছোট, তখনই আমার স্বামী আমাকে তালাক দেন। এরপর ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিই। তাঁদেরও নিজের ঘরবাড়ি কিছু ছিল না। অনেক কষ্ট করেই চলতে হয়েছে। ’
নাইম সুলতানা বলতে থাকেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে বাড়ি ও জমি দিয়েছেন। নিজের নামে জায়গা, ঘর হওয়ার পর আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। গত মাসে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা কারখানায় কাজ নিয়েছি। বাড়িতে সেলাই মেশিন চালিয়েও কিছু রোজগার হচ্ছে। এখন ভালো আছি। ’
একই আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাড়ি পেয়েছেন রিমা ও মিশুর উদ্দিন দম্পতি। তাঁরা এখন নিজের বাড়ির সামনে মুদিখানা দিয়েছেন। সঙ্গে দুটি গরু ও ৯টি ছাগল পালন করছেন। মিশুর উদ্দিন ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান। সব মিলিয়ে তাঁদের ভালোই রোজগার হচ্ছে।
রিমা বলেন, ‘সরকার বাড়ি দেওয়ার পর মুদিখানা দিয়েছি। ছাগল বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছি। দোকানের লাভ ও ছাগল বিক্রির টাকায় আমার স্বামী ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনেছেন। দুজন মিলে ভালোই আয় হয়। ’
গোগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, রানীনগর গড়বাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পে মোট ১৩০টি বাড়ি তৈরি করে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখানে যারা বাড়ি পেয়েছে, একদিকে তারা যেমন আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছে, অন্যদিকে তাদের আত্মমর্যাদাবোধও বাড়ছে।
একটি মানুষও যেন গৃহহীন না থাকে, সে লক্ষ্যে সরকার বাস্তবায়ন করছে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২। এ প্রকল্পের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে এক লাখ ১৭ হাজার ৩২৯টি বাড়ি দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ে তৈরি করা হচ্ছে ৬৫ হাজার ৪৭৪টি বাড়ি।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পরিচালক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা হচ্ছে, দেশে একজনও ভূমিহীন, গৃহহীন থাকবে না। প্রতিটি মানুষের যেন একটা ঠিকানা থাকে, সেটি আমরা নিশ্চিত করব। যত দিন পর্যন্ত ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে, তত দিন আমাদের কার্যক্রম চলবে। ’