ডেস্ক নিউজ
পদ্মা ও যমুনার চরে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন নদীভাঙা মানুষেরা। এক সময় যে নদী ছিল তাদের দুঃখের কারণ, সে নদীর বুকে জেগে ওঠা চরই এখন বদলে দিয়েছে তাদের ভাগ্য। ভাঙনকবলিত মানুষ তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলছেন। নদীর পলিভরা চরে তারা ফলিয়েছেন বাদাম, সরিষা, তিল, তিষি, শাকসবজি, কলা ও থাই কুলসহ বিভিন্ন ফসল। গড়ে তুলেছেন ছোট ছোট গোখামার। এসব খামারের দুধ, গোশত ও কৃষিপণ্য বদলে দিচ্ছে তাদের ভাগ্য।
পাবনা সদর, ঈশ্বরদী, সুজানগর ও বেড়া এবং সিরাজগঞ্জের সদর, কাজিপুর, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলায় যমুনা ও পদ্মার বুকে জেগে ওঠা চরে ভাঙনকবলিত মানুষের গড়া গোখামারগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় দেড় লাখ লিটার দুধ উৎপাদিত হচ্ছে। এই দুধ চরবাসীর চাহিদা মিটিয়ে জেলা ও উপজেলার হাটবাজারে দেদার বিক্রি হচ্ছে। সরবরাহ করা হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি দুগ্ধ পক্রিয়াজকরণ প্রতিষ্ঠানে।
নদী ভাঙনে নিঃস্ব পরিবারগুলোর বসতভিটা পর্যন্ত ছিল না। তারা পাবনার বেড়া, সুজানগর, ঈশ্বরদী এবং সিরাজগঞ্জের চৌহালী, শাহজাদপুর উপজেলার পদ্মা-যমুনার বুকে জেগে ওঠা চরে বসতি গড়ে তোলে। তাদেরই একজন আলম প্রামাণিক বেড়া উপজেলার চর নাকালিয়া গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। অন্যের জমিতে কামলা খেটে ও বর্গাচাষি হিসেবে কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। এক বেলা খাবার জুটলেও অন্য বেলায় জুটত না। ১৫ বছর আগে আলম প্রামাণিকের অবস্থাটা এমনই ছিল। আজ তার ঘরবাড়ি, জমিজমা সব হয়েছে। এলাকায় তিনি এখন অন্যতম এক সচ্ছল মানুষ। এই কয়েক বছরে সব মিলিয়ে তার সম্পদের মূল্য দাঁড়িয়েছে অন্তত ১০ লাখ টাকার। কোনো আলাদিনের চেরাগে তার ভাগ্যের এই পরিবর্তন হয়নি। আলম প্রামাণিক বলেন, ‘আমার ভাগ্য বদলায়ে দিছে গরু। এনজিওর ঋণে দুইড্যা বকনা বাছুর কিনছিলাম। আইজ আমার গোয়ালে ছয়ডা গাভি। দৈনিক দেড় মণ দুধ পাই। গরু পালনই আমার একমাত্র পেশা।’ আলম প্রামাণিকের মতো শুধু গরু পালনে ভাগ্য বদল করেছেন চরাঞ্চলের অনেকেরই।
যমুনা নদীপাড়ের নাকালিয়া বাজারটি বেড়া, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার অন্তত ৪০টি চরের বাসিন্দাদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। এই বাজারে বসে কথা হচ্ছিল চরনাগদা গ্রামের বাসিন্দা ও একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ঈসমাইল মোল্লার সাথে। তিনি জানান, ১৫ বছর আগেও চরে এত গরু ছিল না। তখন হাতেগোনা কয়েকটি গৃহস্থ পরিবার উন্নত জাতের গাভি পালন শুরু করে। গাভির দুধ থেকে ভালো আয় এবং গরু মোটাতাজাকরণে ব্যাপক লাভ দেখে তখন থেকে গরু পালনে আগ্রহী হয়ে উঠে অনেকেই। এভাবে শুরু হয় চরে প্রতিটি বাড়িতে গরুর খামার।
পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া উপজেলায় গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান দুগ্ধ উৎপাদনকারী ও গরু পালনকারী এলাকা। গরুর খামার ও গরু পালনকারীর সংখ্যা চর এলাকায় এত ব্যাপক হারে বাড়ছে যে তা রীতিমতো বিস্ময়কর। এর কারণ হলো চর এলাকায় গরু পালনের খরচ অন্য এলাকার তুলনায় অর্ধেকেরও কম। তাই লাভ বেশি।
চৌহালী উপজেলার আওলাদ হোসেন জানান, গ্রাম এলাকায় সারা বছরই গোখাদ্য কিনে খাওয়াতে হয়। সেখানে কাঁচা ঘাস কম বলে খর-ভুসির ওপরাই বেশি নির্ভরশীল থাকতে হয়। কিন্তু চরে বিষয়টি ভিন্ন। এখানে বর্ষার চার মাস ছাড়া বাকি আট মাসে প্রচুর ঘাস পাওয়া যায়। প্রায় বিনা মূল্যেই পাওয়া যায় ঘাস। ফলে গরু পালনে খরচ পড়ে অনেক কম। গরুগুলো কাঁচা ঘাস বেশি পায় বলে দুধও দেয় বেশি।
সিরাজগঞ্জের মিনারদিয়াচর, ওমরপুরচর, পাবনার চরপেঁচাকোলা, দক্ষিণ চরপেঁচাকোলা, চরনাকালিয়া, চরনাগদা, চারসাঁড়াশিয়া, চরহাটাইলআড়ালিয়া, চরসাফুল্যা, চরআগবাগসোহা, চরকল্যাণপুর, ঢালারচরসহ বেড়ার সব চরই গরু পালনের জন্য আদর্শ জায়গা হয়ে উঠেছে। চরগুলোর দূরত্ব ১৫ থেকে ৩৫ কিলোমিটার। বসবাসকারীর সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার।
স্থানীয় প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কার্যালয় ও কয়েকটি দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ ছাড়া উপজেলার হাট-বাজারসহ ছানার কারখানা ও মিষ্টি দোকানেও প্রচুর দুধ সরবরাহ হচ্ছে এসব চরাঞ্চল থেকে।
বেড়া প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা স্বর্ণালী জাহান পান্না বলেন, গরু পালন করে চরের মানুষ গত এক যুগে যে সাফল্য পেয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। দু’টি জেলার চরগুলোর মধ্যে চর নাকালিয়া, চর নাগদা, দক্ষিণ চর পেঁচাকোলা, মিনারদিয়াচর, ওমরপুরচরসহ অন্তত ২৫টি চরে গরু পালনে বিপ্লব ঘটে গেছে।