ডেস্ক নিউজ
বুড়িগঙ্গার যৌবন ভাটা পড়েছে বহু আগে। দখল-দূষণে প্রাণ যায় যায় নদীর। কিন্তু ঢাকার প্রাণ এ নদীকে ঘিরে শুরু হওয়া কর্মযজ্ঞ থেমে নেই। বুড়িগঙ্গার এক তীরে তিলোত্তমা ঢাকা, অন্য তীরে কেরানীগঞ্জ উপজেলার আগানগর ও শুভাঢ্যা ইউনিয়ন। আগানগর ও শুভাঢ্যায় আশির দশক থেকে সীমিত পরিসরে শুরু হয় তৈরি পোশাক কারখানা। শুরুটা হয়েছিল পুরোনো কাপড় জোড়াতালি দিয়ে। বুড়িগঙ্গার পাড়ে দূরদূরান্ত থেকে ঝুট কাপড়ভর্তি নৌযান আসত। আশপাশের লোকজন সেগুলো পুঁজি করেই ব্যবসা শুরু করেন। থাকতেন ছোট ছোট বাঁশের ছাপরায়। এখন সেখানে বড় বড় দালান। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, পূর্ব আগানগর গুদারাঘাট, আগানগর ছোট মসজিদ, চরকালীগঞ্জ ও খেজুরবাগ এলাকা মিলিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটারজুড়ে এখন ছোট-বড় পোশাকশিল্প কারখানা। গড়ে উঠেছে তিন শতাধিক ছোট-বড় মার্কেট। ছোট ও মাঝারি আকারের পোশাক কারখানাসহ রয়েছে প্রায় ১০ হাজারের বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে মালিক সমিতির নিবন্ধিত সদস্য ছয় হাজার। ঈদকে ঘিরে পোশাকশিল্পের বড় এই জনপদ জেগে থাকে রাত-দিন।
গত দুই বছর ঈদের আগে করোনার চোখ রাঙানিতে কারখানা-দোকান খুলতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। বড় অঙ্কের লোকসান গুনেছেন। দিনে দিনে ভারী হয়েছে ঋণের বোঝা। স্বপ্ন ভাঙা ব্যবসায়ীরা আশায় ছিলেন সুদিনের। অবশেষে সেই সুদিন ধরা দিয়েছে। পোশাকপল্লিতে যে ‘ঈদ’ চলছে তার প্রমাণ মিলেছে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার সরেজমিন ঘুরে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাইকাররা আসছেন। ঘুরে ঘুরে কিনছেন পছন্দসই পোশাক। বেচাকেনাও বেশ। শুধু মার্কেট কিংবা দোকান নয়, ফুটপাতও বাদ যায়নি বেচাকেনার এই আয়োজনে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই বেচাকেনার হাট সরগরম থাকবে ঈদের আগের দিন অর্থাৎ চাঁদ রাত পর্যন্ত। তবে পাইকারদের আনাগোনা কমে যাবে ২৫ রমজানের পর।
ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের অভ্যন্তরীণ পোশাক চাহিদার ৮০ শতাংশ বাজার এই পল্লির দখলে। সারা বছরের ৬০-৭০ শতাংশ বেচা-বিক্রি হয় এই ঈদের আগে। এ সময় আনুমানিক এক হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়- এমনটিই জানালেন ব্যবসায়ী নেতারা।
এবার শুধু ঈদ নয়, পহেলা বৈশাখেও চাঙ্গা ছিল ব্যবসা। কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুসলিম ঢালী জানান, পোশাকপল্লিতে প্রায় ১০ হাজার তৈরি পোশাকের দোকান ও কারখানা রয়েছে। বৈশাখ উপলক্ষে ১৫০০ থেকে ২০০০ কারখানায় পোশাক তৈরি করা হচ্ছে। তার মতে, এ বছর বৈশাখের বাজারে প্রায় ১০ কোটি টাকার তৈরি পোশাক বিক্রি হয়েছে।
আলম টাওয়ার মার্কেটের নিউ জেরিন ফ্যাশনের মালিক আলী আকবর বলেন, এ বছর পহেলা বৈশাখের চাহিদা মাথায় রেখে ২০ হাজার পাঞ্জাবি ও ফতুয়া তৈরি হয়েছে তার এখানে। সব বিক্রি হয়ে গেছে। ঈদ উপলক্ষে বরিশাল, পটুয়াখালী, চিটাগাং, রাজশাহী, যশোর, খুলনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ক্রেতারা আসছেন, দেখছেন, কিনছেন।
তবে ব্যাংক লোনের অভাবে চাহিদামতো উৎপাদন করতে না পারায় মালের সংকট রয়েছে বলে জানান কয়েকজন ব্যবসায়ী। নূর সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী মফিজুর রহমান বলেন, বাইরে থেকে মাল আসতে নানা জটিলতায় পড়তে হয়েছে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় মালের দামও বেড়েছে। এ ছাড়া এক বছর আগে থেকেই সুতার দাম বেশি। ওই হিসাবে পণ্যের দাম বাড়তি। আর পর্যাপ্ত মজুত নেই।
চৌধুরী মার্কেটের আব্দুর রহমান বলেন, জিনিসপত্রের দাম বেশি। সে জন্য ক্রেতারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছেন। নোয়াখালী থেকে আসা ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, এ বছর পণ্যের দাম বেশি। এত দামে মাল নিয়ে বেচতে পারব কিনা, তা নিয়ে দ্বিধায় আছি।
কেরানীগঞ্জের পাইকারি বাজারে প্রতিটি জিনস প্যান্ট বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। তবে কিছু দোকানে হাজার টাকায়ও ভালো মানের জিনস বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া পাঞ্জাবি ২৫০-৬০০ টাকা, শার্ট ১৫০-৫০০ টাকা, টি-শার্ট ৬০- ২০০ টাকা, মেয়েদের থ্রিপিস ২৫০-৫০০ টাকা ও লেহেঙ্গা ৪৫০-৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কেরানীগঞ্জের জেলা পরিষদ মার্কেটের ব্যবসায়ী মামুন হোসেন বলেন, গত দুই বছর করোনার কারণে ব্যবসা করতে পারিনি। লোকসান গুনতে গুনতে পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এবার ব্যাংক থেকে ঋণ পেলাম না। যেটুকু পুঁজি ছিল তা দিয়ে অল্পকিছু পণ্য বানিয়েছি। যার অধিকাংশই বিক্রি হয়ে গেছে। নতুন চাহিদা এলেও পণ্য দিতে পারছি না।
ব্যবসায়ীরা জানান, এখানে ৩০-৩২টি ব্যাংকের শাখা আছে। কিন্তু অনেক ব্যাংকই ঋণ দিতে আগ্রহী ছিল না। পোশাকের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে ৩০টির বেশি কুরিয়ায় সার্ভিস প্রতিষ্ঠান। আছে বোতাম, চেইন, লেইস-ফিতা, সুতার দোকান। এসব প্রতিষ্ঠানও এবার ভালো ব্যবসা করেছে। পোশাক ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে তিন লক্ষাধিক লোকের। কেরানীগঞ্জের এই পোশাকপল্লিতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ নিয়মিত পেলে পোশাক খাতে অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে- এমনটাই প্রত্যাশা এখানকার ব্যবসায়ীদের।
গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও কেরানীগঞ্জ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি স্বাধীন শেখ জানান, দুই বছরের নিস্তব্ধ পল্লি আবার সরগরম হয়ে উঠেছে। লোকসানের মুখে থাকা ব্যবসায়ীরা লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছেন। এবার আরও ভালো ব্যবসা করা সম্ভব ছিল। কিন্তু গত দুই বছরের অভিজ্ঞতায় অনেক ব্যবসায়ী ঝুঁকি নিতে চাননি। এ ছাড়া মূলধন সংকট, কাপড় ও সুতার বাড়তি দামের কারণেও ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি ব্যাহত হয়েছে।
এদিকে অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই পোশাকপল্লিতে মার্কেটগুলো খুবই ঘিঞ্জি পরিবেশে গড়ে উঠেছে। সড়কগুলো অপ্রশস্ত। অল্প বৃষ্টিতেই কাদাপানিতে সয়লাব হয়ে যায়। নীরব চাঁদাবাজির ঘটনাও ঘটছে অহরহ। দেশের অর্থনীতিতে এসব কারখানার বিশেষ অবদান থাকলেও ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, গ্যাসসহ নানা সমস্যা সমাধানে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। সম্ভাবনা বিবেচনা আর পরিবেশের সুরক্ষায় এই পোশাক পল্লিকে দ্রুত শিল্পাঞ্চলের আওতায় আনলে সব পক্ষই উপকৃত হতে পারে।