ডেস্ক নিউজ
মহামারী করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের পণ্য রফতানি খাত। একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে দেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাকখাত। পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ নতুন রেকর্ড করতে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে রফতানি হয়েছে ৪ হাজার ৩৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। দেশীয় মুদ্রায় যা পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকার সমান। দেশের ইতিহাসে এই পরিমাণ পণ্য রফতানি আগে কখনো হয়নি। সেই হিসাবে এখন পর্যন্ত এটিই সর্বোচ্চ। এখনো চলতি অর্থবছরের দুই মাস বাকি। ফলে অর্থবছর শেষে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পণ্য রফতানি হবে। রফতানিকারকেরা আশা করছেন, বছর শেষে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে পণ্য রফতানি পাঁচ হাজার কোটি ডলার বা ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে পৌঁছে যাবে। জিএসপি স্থগিত থাকার পর একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রফতানিতে ভালো করছে বাংলাদেশ। বড় এই বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা বেড়েছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি, শ্রমমান উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক মানের কারখানা গড়ে তোলা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ভালো মানের পোশাক অপেক্ষাকৃত কম দামে বিক্রি করার কারণে বহির্বিশ্বে পোশাকের বাজার বড় হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, পোশাকখাতের রফতানি বাড়লেও আগামীতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এরমধ্যে এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী সময়ে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা নিশ্চিত করার বিয়ষটি অন্যতম। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পোশাক উচ্চমূল্যে বিক্রি হলেও বিদেশী ক্রেতারা (বায়ার) সে তুলনায় দেশে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করছে না। ট্রেড ইউনিয়নের নামে কারখানায় বিশৃঙ্খলা তৈরি করার মতো বিষয় রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে পোশাকখাতের ইতিবাচক ভাবমূর্তি ফিরে আসায় এখন বিদেশী ক্রেতারা বাংলাদেশমুখী হচ্ছেন।
পোশাকের প্রধান ক্রেতা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীলের মর্যাদায় চলে যাওয়ার পরও বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া নতুন নতুন বাজারে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশের পোশাক। আর এ কারণেই বিশ্বে পোশাকের বাজার বড় হচ্ছে। অন্যদিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে ২০১৯ সালে দেশটির অনেক প্রতিষ্ঠান বিকল্প উৎস হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নেয়। তবে করোনার থাবায় রফতানি আবার নিম্নমুখী হতে থাকে। গত বছরের মে মাস থেকে বাজারটিতে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি আবার বাড়াতে শুরু করে। শুধু তাই নয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেও বিশ্ব বাণিজ্য নতুন মোড় নিতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকেও নতুন কৌশল নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ জনকণ্ঠকে বলেন, করোনা সঙ্কট মোকাবেলা করে বাংলাদেশের রফতানিখাত অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে পোশাক রফতানিতে নতুন নতুন রেকর্র্ড হচ্ছে। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে ভাল দিক। তিনি বলেন, পোশাকের পাশাপাশি পণ্য বহুমুখীকরণের উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। এ কারণে হোম টেক্সটাইল, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং চামড়া খাতে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি রফতানি আয় হচ্ছে। অর্থাৎ এই তিনখাতের প্রতিটিতে ১ বিলিয়ন ডলার বা সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় হচ্ছে। এছাড়া দেশের মৎস্য ওষুধ, জাহাজ, শাকসবজিসহ অন্যান্য খাতের রফতানি প্রবৃদ্ধি ভাল হচ্ছে। রফতানি আয় বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে নগদ সহায়তা দেয়ার কারণে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন। নতুন নতুন বিনিয়োগকারী বেরিয়ে আসছে। আগামী বাজেটেও রফতানিবান্ধব কর্মসূচী গ্রহণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, মহামারী করোনা সঙ্কটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আগামী তিনবছরের জন্য রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০ বিলিয়ন ডলার। যা বর্তমান রফতানি নীতির চেয়ে ২০ বিলিয়ন ডলার বেশি। নতুন রফতানি নীতিতে গার্মেন্টেসের পাশাপাশি পণ্যবহুমুখীকরণ, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সফলভাবে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ, দক্ষ জনশক্তি তৈরি, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও বাণিজ্যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের মতো লক্ষ্যমাত্রায় সর্বোচ্চ জোর দেয়া হয়েছে। পণ্য উৎপাদন ও রফতানি বাড়াতে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডিংকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নতুন রফতানি নীতিতে। এদিকে, সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য ও সেবা মিলিয়ে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল ৪ হাজার ৫৩৭ কোটি ডলার। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫১ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে পণ্য রফতানি থেকে ৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার এবং সেবা খাত থেকে ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার আয় হবে বলে সরকার আশা করছে। ইপিবির সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস শেষে পণ্য রফতানিতে ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। এ সময়ে ২ হাজার ৪৬৯ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে যা ছিল এক হাজার ৯২৩ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। মহামারীর কারণে গত বছর বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
এদিকে, মহামারী করোনার মধ্যেও পোশাক কারখানা চালু রাখায় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। এক প্রকার তোপের মুখে পড়েছিল সরকার। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত যে বেশ ফল দিয়েছে, তা এখন মানছেন সমালোচকরাও। কঠিন সময়েও উৎপাদনের চাকা সচল থাকায় আস্থা বেড়েছে বিদেশী ক্রেতাদের। ফলে অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই অর্জিত হয়ে গেছে পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রা। পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে শীর্ষে চীন। এরপর বাংলাদেশের অবস্থান। কিন্তু গত বছর রফতানিতে ভিয়েতনামের নিচে পড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। এতে করে এক ধরনের চিন্তার ভাঁজ তৈরি হয়েছিল। কারণ, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত এ পোশাক। লকডাউনের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে দেশের পোশাক কারখানা খোলা রেখে প্রতিকূল এক পরিস্থিতি বিচক্ষণতার সঙ্গে সামাল দিয়েছে সরকার। এর ফলে সমূহ ধকলের আশঙ্কায় থাকা পোশাক খাত বেশ ভালভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বলে জানিয়েছেন পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ নেতারা।
বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী অর্থ বছরের প্রথম দশ মাসে পোশাক রফতানি থেকে অর্জিত হয়েছে ৩৫ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এবার বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন। বছরের দুই মাস বাকি থাকতেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ২২ কোটি ডলারের পণ্য বেশি রফতানি হয়েছে। সকল পণ্য মিলিয়ে এবারের রফতানির টার্গেট ছিল ৪৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার, যার প্রায় পুরোটাই অর্জিত হয়ে গেছে। দশ মাসে দেশের সর্বমোট রফতানি আয় ৪৩ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার।
অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে রফতানির এই পরিমাণ ভবিষ্যতে আরও উজ্জ্বল সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। উদীয়মান অর্থনীতির বাংলাদেশ এখন জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার ওপরে। বিশেষ করে পোশাক শিল্প ক্রমেই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব বাজারে স্থান সংহত করে নিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে পোশাক উৎপাদন ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম সহ সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থবছরের দুই মাস বাকি থাকতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে ফেলাটা নিঃসন্দহে উদ্দীপনামূলক। বাকি সময়ে যা অর্জিত হবে তাতে এবার পোশাক রফতানি থেকে মোট আয় দাঁড়াতে পারে ৪২ থেকে ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বেশকিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশের পোশাক খাতের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শক্ত অবস্থান করে নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
বৈশি^ক মহামারী করোনার মধ্যেও রফতানির প্রবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিজিএমইএর এই নেতা বলেন, পোশাক কারখানা খোলা রাখা নিয়ে ব্যক্তি ও বিভিন্ন মাধ্যমে অনেক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু জীবন ও জীবিকার সমন্বয় বিবেচনায় উৎপাদন চালু রাখার যে সিদ্ধান্ত তা যৌক্তিক ছিল। আজ প্রমাণিত যে, এটা ছিল আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী এক সিদ্ধান্ত। ওই সময়ে পোশাক শিল্পের অবস্থান ধরে রাখতে সরকারীভাবে প্রণোদনাও দেয়া হয়েছে। উৎপাদন ও রফতানি ঠিক ছিল বলেই আমরা করোনা পরবর্তী সময়ে কিছু দেশের মতো ডলার সঙ্কটজনিত আতঙ্কে ভুগছি না। করোনাতেও পোশাক কারখানা চালু থাকায় বিদেশী ক্রেতারা আমাদের ওপর আস্থা রেখেছেন। আমরা ইউরোপ, আমেরিকা থেকে নতুন বায়ার পেয়েছি। অনেকেই বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী হয়েছে। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে টপকে গিয়েছিল। কিন্তু যথাযথ পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশ ফের তার অবস্থানে উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, এ রফতানি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকায় একটি ভাল সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রফতানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভাল সম্ভাবনার আরেকটি কারণ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আন্তর্জাতিক রুটের বহুমুখীকরণ। পোশাকের সবচেয়ে বড় ভোক্তা ইউরোপ এবং আমেরিকা। পোশাক এমনই পণ্য যে, এতে হাল ফ্যাশনের একটা ব্যাপার রয়েছে। অর্থাৎ ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে পোশাকও বদলায়। সেক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পণ্য পৌঁছাতে পারা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এতদিন ধরে বেশ প্রতিকূলতার মধ্যে ছিল। কারণ, আমাদের রফতানি পণ্য গন্তব্যে পৌঁছায় বিভিন্ন ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে। এতে সময়ক্ষেপণের পাশাপাশি ব্যয়ও বেড়ে যায়। এখন চট্টগ্রাম থেকে ইউরোপের বন্দরে সরাসরি জাহাজ চলাচল করতে শুরু হয়েছে। চীনা রুটেও জাহাজ চালু হতে যাচ্ছে।
বিজিএমইএ নেতারা বলছেন, রফতানির প্রধান গন্তব্য ইউরোপ-আমেরিকা। আর কাঁচামাল আমদানি হয় প্রধানত চীন থেকে। এই দুই রুটে সরাসরি জাহাজ চলাচল নিয়মিত হয়ে গেলে আমদানি এবং রফতানি উভয়ক্ষেত্রে অনেক সময় বেচে যাবে, যার পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার জন্য খুবই প্রয়োজন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ তৃতীয় শীর্ষ তৈরি পোশাক রফতানিকারক। ওই বাজারে গত বছর বাংলাদেশ ৭১৫ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করে। ২০২০ সালের চেয়ে এই আয় প্রায় ৩৭ শতাংশ বেশি। চলতি বছরের প্রথম মাসে সেই প্রবৃদ্ধিকেও টপকে গেছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা।