প্রকল্পটি চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণের হলেও বস্তুত সাগরপাড়ের বে-টার্মিনাল হতে যাচ্ছে নতুন এক আধুনিক বন্দর। বিদ্যমান বন্দরের তুলনায় দ্বিগুণ সাইজের দ্বিগুণসংখ্যক জাহাজ ভিড়তে পারবে এই টার্মিনালে, যেখানে ২০২৪ সালের মধ্যে জাহাজ ভেড়াতে চায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। পণ্য হ্যান্ডলিং দক্ষতা, উৎপাদনশীলতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে বে-টার্মিনাল, যা গড়ে উঠছে গভীর সমুদ্র বন্দরের আদলে। কেউ বলেন আগামীর বন্দর, আবার কেউ বলেন বিকল্প বন্দর। তবে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষমতা উন্নীত হবে তিনগুণে। এই টার্মিনাল আমূল বদলে দেবে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা।
দেশের অর্থনীতির আকার এবং আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান সুবিধা দিয়ে সেবা প্রদান কঠিন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ী সমাজ ও বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেক আগে থেকেই এক প্রকারের উদ্বেগ পরিলক্ষিত হয়। তারা দাবি জানিয়ে আসছিলেন বে-টার্মিনাল নির্মাণের মাধ্যমে বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার। দীর্ঘসূত্রতা অনেক থাকলেও অবশেষে বে-টার্মিনাল নির্মাণ এখন বাস্তবতা। ভূমি অধিগ্রহণসহ প্রয়োজনীয় প্রাথমিক প্রক্রিয়াগুলো এর মধ্যে সম্পন্ন করে আনা হয়েছে। আগামী ৩১ মে চুক্তি হবে দুই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার দুই প্রতিষ্ঠান কুনওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড কনসালটিং কোম্পানি লিমিটেড এবং ডিয়েন ইয়াং ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। চুক্তি স্বাক্ষরের পর টার্মিনালের ডিজাইন প্রস্তুত কাজ দ্রুত সম্পন্ন হবে। এতে ব্যয় হতে যাচ্ছে ১২৬ কোটি ৪৯ লাখ ৭৩ হাজার ৯৮৬ টাকা। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এ কার্যক্রমে সময় নেবে আট থেকে নয়মাস। এর আগে গত ৭ এপ্রিল সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে পরামর্শক নিয়োগের বিষয়টি অনুমোদিত হয়। বিভিন্ন দেশের ৫টি প্রতিষ্ঠান পরামর্শক হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। শেষ পর্যন্ত যাচাই-বাছাই করে যৌথভাবে এই দুই কোরীয় প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়া হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণে বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনেক আগেই দেখা দিয়েছিল। কেননা অর্থনীতির আকার যেভাবে বাড়ছে তাতে বিদ্যমান বন্দর সুবিধায় সেবা প্রদান ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছিল। সে কারণে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের আগেই বে-টার্মিনাল নির্মাণের ওপর বেশি জোর দিয়েছিলেন তারা। তবে এখন গভীর সমুদ্র বন্দর এবং বে-টার্মিনাল দুটির কাজই এগিয়ে চলেছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর আগামী ৩১ মে হলেও মাটি ভরাটসহ প্রাথমিক কিছু কাজ আগে থেকেই এগিয়ে নেয়ার কাজ চলমান রেখেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বহু প্রত্যাশার বে-টার্মিনাল নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে চীনের চায়না মার্চেন্টস স্পোর্টস হোল্ডিং কোম্পানি লিমিটেড, সিঙ্গাপুরভিত্তিক পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড, ভারতের আদানি পোর্ট, ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালস, দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই গ্রুপ এবং ইন্টারন্যাশনাল পোর্ট ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন। টার্মিনালটি নির্মাণ করা খুবই প্রয়োজন বিধায় দীর্ঘসূত্রতায় না গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। টার্গেট অনুযায়ী ২০২৪ সালের মধ্যে এর একাংশের কাজ সম্পন্ন করা হবে।
বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংস্থা বলছে, আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে তাতে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে বার্ষিক অন্তত ১০ মিলিয়ন কন্টেনার হ্যান্ডলিং করতে হবে। এর মধ্যে অন্তত ৫ মিলিয়ন কন্টেনার হ্যান্ডলিং করার টার্গেট চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। সে লক্ষ্য নিয়ে বিদ্যমান বন্দরের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি নির্মাণ করা হচ্ছে বে-টার্মিনাল। সাগরপাড়ের সাড়ে ৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই টার্মিনাল হতে যাচ্ছে। টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার (ঢেউ নিয়ন্ত্রক) নির্মাণে সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে বিশ^ব্যাংক। বে-টার্মিনালে থাকবে মোট ৩টি টার্মিনাল, যার মধ্যে একটি নির্মাণ করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বাকি দুটির কাজ হবে কোন বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) ভিত্তিতে।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বন্দর বছরে ৩ মিলিয়ন বা ৩০ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করছে। শিল্পায়ন এবং আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে তাতে বিদ্যমান বন্দর সুবিধা দিয়ে আর বেশিদিন চলবে না। ২০২৫ সালের মধ্যে বে-টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। তবে তিনটির মধ্যে যে টার্মিনালটি বন্দর নির্মাণ করবে, তাতে ২০২৪ সালের মধ্যে জাহাজ ভেড়াবার টার্গেট রয়েছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাশমনির ঘাট পর্যন্ত সাগরপাড়ে সাড়ে ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ২ হাজার ৩শ’ একর এলাকাজুড়ে হবে বে-টার্মিনাল। একটি টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দর নিজেই বাস্তবায়ন করবে। অপর দুটির জন্য বিদেশী আগ্রহী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের পৃথকভাবে টেকনিক্যাল ও ফিন্যান্সিয়াল প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। যেহেতু দেশের অর্থনীতির কলেবর বাড়ার কারণে চাহিদা বাড়ছে, সেহেতু এক্ষেত্রে বিলম্ব করার অবকাশ নেই।
সূত্র জানায়, বে-টার্মিনালের তিনটি টার্মিনালই হবে সমান আয়তনের। এর মধ্যে দক্ষিণ পাশের টার্মিনালটি আগে নির্মিত হবে, যা বাস্তবায়ন করবে চট্টগ্রাম বন্দর। প্রতিটি টার্মিনালে চারটি করে জেটি হবে। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে টার্মিনালের জন্য ৬৮ একর জায়গা পায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপর পর্যায়ক্রমে মিলছে বাকি ভূমি। মোট ৯০৭ একর ভূমিতে হচ্ছে বে-টার্মিনাল। এর মধ্যে ৬৮ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, বাকি ৮৩৯ একর সরকারী। এখন যে পর্যায়ে তাতে আর প্রকল্প বাস্তবায়নে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা নেই।
ব্যবসায়ীদের অন্যতম শীর্ষ সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, বে-টার্মিনাল বাংলাদেশের অর্থনীতির চাহিদা। এটি আরও আগেই করা প্রয়োজন ছিল। বিলম্ব হলেও কাজ মাঠে গড়িয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের দাবি ছিল ২০২১ সালের মধ্যে বে-টার্মিনাল নির্মাণ করার। এখন বন্দর কর্তৃপক্ষের টার্গেট ২০২৪ সালের মধ্যে। এটি যেন আবারও দীর্ঘসূত্রতায় না গড়ায়। দেশের রফতানি আয় ৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে প্রধানমন্ত্রীর যে লক্ষ্য, তা পূরণ করতে হলে বন্দর সুবিধা অবশ্যই বাড়াতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) অর্জনের যে লক্ষ্য, তার জন্যও বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এমনই অভিমত রাখেন ব্যবসায়ী সমাজের এই নেতা।
বে-টার্মিনালে বন্দরের সক্ষমতা হবে তিনগুণ ॥ চট্টগ্রাম বন্দর এখন যে পরিমাণ কন্টেনার হ্যান্ডলিং করে বে-টার্মিনাল একাই তার দ্বিগুণ হ্যান্ডলিং করতে পারবে। ফলে কাজ শেষ করে অপারেশনে যাবার পর বন্দরের সক্ষমতা হয়ে যাবে তিনগুণ। বর্তমান চ্যানেল দিয়ে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের (গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারে। এ সাইজের জাহাজ ১৮০০ টিইইউএস কন্টেনার বহন করতে পারে। বে-টার্মিনালে ভিড়তে পারবে ১২ মিটার ড্রাফটের বড় জাহাজ, যা ৫০০০ টিইইউএস কন্টেনার পর্যন্ত বহন করতে সক্ষম হবে।
বিদ্যমান বন্দর সম্পূর্ণ জোয়ার-ভাটা নির্ভর। জাহাজ ভেড়ানোর জন্য জোয়ার এবং ছাড়ার জন্য ভাটার অপেক্ষায় থাকতে হয়। সমুদ্র থেকে ১৫ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত বর্তমান জেটিগুলো। এটুকু আসতে বেশকিছু বাঁকও রয়েছে। এতে জাহাজ চলাচলে ঝুঁকি যেমন থাকে, তেমনিভাবে দূরত্বের কারণে সময়ও বেশি লাগে। বিদ্যমান জেটিগুলোতে চব্বিশ ঘণ্টা জাহাজ আসা-যাওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু বে-টার্মিনাল সাগরপাড়ে হবে বিধায় সেখানে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা জাহাজ আসা-যাওয়া করতে পারবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান ফ্যাসিলিটিতে একসঙ্গে ১৯টি জাহাজ ভিড়তে পারে। বে-টার্মিনালে ভিড়তে পারবে অন্তত ৩৫ জাহাজ। পরে এই সুযোগ আরও বাড়ানো সম্ভব হবে। সাগর থেকে শূন্য কিলোমিটারের মধ্যেই হতে যাচ্ছে টার্মিনালের অবস্থান। বে-টার্মিনাল হলে শুধু সেখানেই বিদ্যমান বন্দরের দ্বিগুণ পণ্য হ্যান্ডলিং করা যাবে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় যে সুবিধাটি পাওয়া যাবে সেটি হলো বন্দরে নামা পণ্যের সহজ পরিবহন। সেখান থেকে অতি সহজে মহাসড়ক ধরে আমদানির পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যেতে পারবে। রফতানি পণ্যের জাহাজীকরণও সহজ হবে। নগরীর বাইরে হওয়ায় বন্দরের ট্রান্সপোর্টগুলো শহরের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে না। এতে যানজটও অনেক কমে যাবে।