ডেস্ক নিউজ
রোমানিয়া, কোরিয়াসহ ২০ দেশে লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ জনশক্তি রপ্তানি : রেমিট্যান্সের জন্য নতুন নতুন শ্রমবাজার খুঁজছে সরকার
বৈশ্বিক মহামারি করোনার ধকল কাটিয়ে রেমিট্যান্স বাড়াতে নতুন নতুন শ্রমবাজার খুঁজছে সরকার। দক্ষ শ্রমিক গড়তে দেয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ। শ্রমিকদের দক্ষ করতে দেশের ৭০টি কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ চলছে। শুধু রাজধানীতেই আছে এমন তিনটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এছাড়া প্রতিটি জেলায় একটি করে কেন্দ্র রয়েছে। এর সুফলও মিলতে শুরু করেছে। এর মধ্যে পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকের সংখ্যাও উল্লেখ্যযোগ্য। তৈরি পোশাক শিল্প, নার্সিং ও গৃহকর্মীর কাজে নারী শ্রমিকদের ব্যাপক চাহিদা থাকায় আগ্রহীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদের কাছ থেকে আসছে বড় অঙ্কের রেমিট্যান্স। সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে ফের সম্ভাবনা দেখা দিলেও অনিশ্চয়তা কাটছেই না। তবে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে রোমানিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ২০টি দেশ।
শ্রমবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক শহিদুল আলম ভোরের কাগজকে বলেন, সরকার চলতি বছর রেকর্ডসংখ্যক শ্রমিক বিদেশে পাঠাতে চায়। রোমানিয়ায় কর্মী পাঠানোর সুবিধার্থে বিএমইটি ভবনে তাদের একটি অস্থায়ী অফিস খোলা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় পৃথিবীর সব দেশেই জনশক্তির চাহিদা বেড়েছে। সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তিনি বলেন, চলতি বছর আমরা লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ শ্রমশক্তি বিদেশে পাঠিয়েছি। এখনো বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিকের চাহিদাপত্র আসছে। এটি সারা বছরই অব্যাহত থাকতে পারে।
শহিদুল আলম আরো বলেন, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শ্রমিকদের দক্ষ করা হচ্ছে। বেশি আয়ের জন্য দক্ষ শ্রমিক গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিকরা উন্নত দেশগুলোয় গিয়ে খরচের তুলনায় বেশি আয় করতে পারবে। গ্রিস, ইতালি, রোমানিয়ার মতো উন্নত দেশে নতুন করে শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভোগান্তি নিরসনে অনলাইন ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, গত চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) মোট ৪ লাখ ২৬ হাজার ৫৫৮ শ্রমিক বিদেশে গেছেন চাকরি নিয়ে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১ লাখ ৮১ হাজার ৪০ জন বেশি। অর্থাৎ আগের একই সময়ের তুলনায় ১৩৫ দশমিক ৬১ শতাংশ শ্রমিক দেশ ছেড়েছেন। তাদের মধ্যে জানুয়ারিতে ১ লাখ ৯ হাজার ৬৯৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯২ হাজার ৫৬৯, মার্চে ১ লাখ ২০ হাজার ৩১৬ এবং এপ্রিলে ১ লাখ ৩ হাজার ৯৭৫ শ্রমিক বিদেশে গেছেন।
বিএমইটির তথ্যমতে, ২০২২ সালের প্রথম চার মাসে মূলত বিশ্বের ২০টি দেশে বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছে ২ লাখ ৬৮ হাজার ৫৮৪ জন, যা মোট জনশক্তি রফতানির ৬১ শতাংশ। এছাড়া ওমানে ৫৬ হাজার ৮৩০, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫১ হাজার ৫৩১, সিঙ্গাপুরে ১৮ হাজার ৬০৬, জর্দানে ৬ হাজার ৬৫৪ ও কাতারে ৬ হাজার ২৪১ জন কর্মী গেছেন। করোনা মহামারির সময় ২০২১ সালে মোট ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন শ্রমিক বিদেশে গিয়েছিলেন। গত ২০২০ সালে ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ শ্রমিক বিদেশে যান চাকরি নিয়ে।
এদিকে ২০২২ সালের প্রথম চার মাসেই নারী জনশক্তি রপ্তানি আগের মাসের তুলনায় বেড়েছে। সব মিলিয়ে গত চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন ৪৩ হাজার ৬১০ জন নারী। এর মধ্যে জানুয়ারিতে গেছেন ১০ হাজার ২৯০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১০ হাজার ৬১২ জন। মার্চে এই সংখ্যা বেড়ে হয় ১১ হাজার ২১১ জন। সর্বশেষ এপ্রিলে এই সংখ্যা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৪১৭ জন। পুরুষদের মতোই সৌদি আরবেই সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিক গেছেন। দেশটিতে গৃহকর্মী থেকে শুরু করে নানা খাতে এই চার মাসে গেছেন ২৭ হাজার ৩১৯ নারী কর্মী, যা মোট নারী জনশক্তি রফতানির ৬২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নারী কর্র্মীর গন্তব্য ছিল ওমান। এই দেশটিতে গেছেন ৭ হাজার ৯৭৫ নারী কর্মী, যা মোট নারী জনশক্তি রপ্তানির ১৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৪৯৮ বা প্রায় ১৫ শতাংশ নারী গেছেন জর্দানে। কাতারে ৭৯০ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৬৪৯ জন, লেবাননে ৮৮ জন, কুয়েতে ৩৭ জন, মরিশাসে ২৮ জন, সিঙ্গাপুরে ২৪ জন ও লন্ডনে গেছেন ১৩ নারী কর্মী। এর বাইরে মালয়েশিয়ায় ৮ জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৭ জন, জাপানে ৩ জন, ইতালিতে ২ জন এবং ১৬৯ নারী কর্মী কাজ নিয়ে গেছেন অন্যান্য দেশে।
মূলত তৈরি পোশাক শিল্প, নার্সিং ও গৃহকর্মীর কাজগুলোর জন্য বাংলাদেশ থেকে নারী কর্মীদের নিয়োগ দেয়া হয় বেশি। একসময় বাহরাইন, লেবানন, জর্দান, হংকংয়ের মতো দেশে প্রচুর নারীকর্মী পাঠানো হতো। তবে সেসব দেশে জনশক্তি রপ্তানি এক রকম বন্ধই হয়ে গেছে। গত চার মাসের হিসাবে দেখা গেছে, বাহরাইনে একজন নারীকর্মীও পাঠানো যায়নি। লেবাননে ৮৮ জন গেলেও লিবিয়া, ইরাক, ব্রুনেই, হংকং, সুদান ও সাইপ্রাসে একজন নারী কর্মীও যাননি।
অন্যদিকে করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় ধীরে ধীরে বাড়ছে বাংলাদেশি কর্মী। গত দুই বছরে সে দেশে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানো কমে গেলেও এখন আবার শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স আসাও বেড়েছে। যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে, তার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া ১৩তম স্থানে রয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে এদেশ থেকে রেমিট্যান্স আসার অঙ্ক ২০০ মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে কোরিয়া থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ২০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৭৮ মিলিয়ন ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১১৩ মিলিয়ন ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯৬ মিলিয়ন ডলার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮১ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে কোরিয়া থেকে।
ঢাকার দক্ষিণ কোরিয়া দূতাবাস ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০০৭ সাল থেকে কোরিয়া এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেমের (ইপিএস) আওতায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া শুরু করে। এরপর প্রতি বছর দেড় থেকে দুই হাজার কর্মী যেতেন কোরিয়ায়। তবে করোনা মহামারির কারণে দেশটিতে কর্মী পাঠানো একেবারেই কমে যায়। বাংলাদেশ থেকে ২০২০ সালে মাত্র ১৪১ ও ২০২১ সালে ১১১ জন কর্মী গেছেন কোরিয়ায়। চলতি বছর কর্মী পাঠানো আবার বেড়েছে। ২০০৭ সাল থেকে ইপিএস কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ থেকে ২৩ হাজার ৪০০ জনের বেশি কর্মী দক্ষিণ কোরিয়া গেছেন। ২০১০ সালে ২ হাজার ৩৩৬ জন, ২০১১ সালে ১ হাজার ৬৮৫ জন, ২০১২ সালে ১ হাজার ৪২৬ জন, ২০১৩ সালে ২ হাজার ১৪৬ জন, ২০১৪ সালে ১ হাজার ৭৩১ জন, ২০১৫ সালে ২ হাজার ২৬৮ জন, ২০১৬ সালে ২ হাজার ৪৯ জন, ২০১৭ সালে ১ হাজার ৭৮৬ জন, ২০১৮ সালে ২ হাজার ৩৫৫ জন, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৬৪৫ জন কর্মী কোরিয়া গেছেন। আর চলতি বছর কোরিয়ায় গেছেন ১ হাজার ৩৩৬ জন। এখনো কর্মী যাওয়া অব্যাহত রয়েছে। বছর শেষে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা আরো বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার ইমিগ্রেশনের তথ্য অনুযায়ী, সে দেশে বাংলাদেশি কর্মী ছাড়াও বিভিন্ন পেশার লোক রয়েছেন। বর্তমানে দেশটিতে বাংলাদেশের ইপিএস কর্মী রয়েছেন ৭ হাজার ৩২৯ জন। শিক্ষার্থী ১ হাজার ২১৫ জন, পেশাজীবী ৪৯১ জন, রেসিডেন্ট ৬২১ জন, স্থায়ী রেসিডেন্ট ১৩৯ জন, অন্যান্য খাতে নিয়োজিত আছেন ৬ হাজার ৫১৬ জন বাংলাদেশি।