ডেস্ক নিউজ
‘পদ্মা সেতু করার জন্য দেশে আমাদের ১৬ কোটি মানুষ আছে, ৮০ লাখ প্রবাসী আছে। বাংলার মানুষ সারা জীবন কি অন্যের সাহায্যে চলবে? নিজের পায়ে দাঁড়াবে না? আত্মনির্ভরশীল হবে না? পদ্মা সেতু আমরা করবই।’ ২০১২ সালের ৪ জুলাই জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন সাহসী উচ্চারণেই বদলে যায় পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে সব অনিশ্চয়তা। প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘোষণা আজ সত্যি হয়েছে, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে অহঙ্কারের প্রতীক স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বাঙালী জাতির স্বপ্ন এখন বাস্তব। প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সততা ও সাহসিকতার প্রতীক স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে উচ্ছ্বসিত গোটা জাতি। অর্থনৈতিক সামর্থ্য-সক্ষমতার প্রতীক এই অবকাঠামোকে উপমহাদেশের গেম চেঞ্জার বলছেন বিদেশী কূটনীতিকেরা। দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প সম্পন্ন করার সাহসের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলছেন, তার দেশ বিশ্বাস করে এই সেতু শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা উপমহাদেশেরই পট পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে।
২০০৭ থেকে ২০০৮ সাল সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে মহাজোট সরকার। দেশের দক্ষিণাঞ্চলবাসীকে সড়কপথে সরাসরি ঢাকায় আনার স্বপ্ন দেখিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ‘দুর্নীতি চেষ্টার’ জটিলতার আবর্তে মহাজোট সরকারের চার বছরেও শুরু করা সম্ভব হয় না সেতুর কাজ। ২০১১ সালে সাড়ম্বরে বিশ্বব্যাংকসহ ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে একে একে চুক্তি করে ওই মেয়াদেই সেতুর কাজ শেষ করার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ১৫.২ অনুচ্ছেদে ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি। তবে ২০১১ সালের শেষ ভাগে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করলে আটকে যায় প্রকল্প। এরপর একে একে ঘটে যায় অনেক ঘটনা। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের ঘোষণা এলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় সরকার। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ওয়াশিংটনভিত্তিক বহুজাতিক এই সংস্থার সমালোচনা আসে। পাশাপাশি নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণাও দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১২ সালের ৪ জুলাই শেখ হাসিনা সংসদে বলেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু করার জন্য দেশে আমাদের ১৬ কোটি মানুষ আছে, ৮০ লাখ প্রবাসী আছে। বাংলার মানুষ সারা জীবন কি অন্যের সাহায্যে চলবে? নিজের পায়ে দাঁড়াবে না? আত্মনির্ভরশীল হবে না? পদ্মা সেতু আমরা করবই।’ বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা একটি পয়সাও ছাড় করেনি, তারা দুর্নীতির অভিযোগ করে। তাদের ভেতর যে দুর্নীতি তা দেখেন।’
২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পদ্মা সেতু প্রকল্পের সবশেষ অবস্থান নিয়ে একটি বিবৃতি দেয় সরকার। সে সময়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব আরাস্তু খানের সই করা ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বিশ্বব্যাংকের আজকের তারিখে (১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩) একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে যে, তারা পদ্মা সেতুর বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের নতুন উদ্যোগ সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। তারা আরও জানিয়েছে যে, বাংলাদেশ সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা আর চাইছে না এবং পদ্মা সেতুর তদন্ত প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দেয় যে, তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ এক্ষুণি শুরু করতে চাচ্ছে এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ছাড়াই কাজটি শুরু করতে হচ্ছে। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানান, পদ্মা সেতু থেকে সরে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে এখন আক্ষেপ করছে বিশ্বব্যাংক। তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক বলেছে, পদ্মা সেতু থেকে সরে যাওয়া ভুল হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, সেই সময়টায় আমি খুব কাছে থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুরো ষড়যন্ত্রটা কেমন বীরত্বের সঙ্গে লড়ে ভ-ুল করে দিলেন সে দৃশ্যও দেখেছি। খুবই দ্রুততার সঙ্গে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে নিজেদের অর্থে এই মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে বিশ্বকে দেখিয়ে দেবেন আমরাও পারি। অর্থ বিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও যখন তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আমরা বলেছিলাম, বাংলাদেশের রফতানি ও রেমিটেন্স আয় উর্ধমুখী। বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল। তাই বিশ্বব্যাংকের ১.২ বিলিয়ন ডলার না নিলেও আমরা আমাদের ব্যাংকিং খাত থেকে এই পরিমাণ বিদেশী মুদ্রার জোগান দিতে সক্ষম। আমরা জানতাম এই পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা এক বছরেই লাগার কথা নয়। তাই সরকার যদি টাকার জোগান দিতে পারে, আমরা ডলারের জোগান দিতে পারব। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি-সহযোগিতায় অগ্রণী ব্যাংক এরই মধ্যে ১.৪ বিলিয়ন ডলার পদ্মা সেতুর জন্য দিতে সক্ষম হয়েছে। বাদবাকি ডলারের জোগানও আমাদের ব্যাংকিং খাত দিতে পারবে। আর তা না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তো আছেই। তিনি বলেন, এত বড় প্রকল্পের অর্থায়ন বাংলাদেশ নিজেদের সম্পদ থেকেই সম্পন্ন করতে পারে সেটিই ছিল এই পদ্মা সেতু বিতর্কের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
অর্থনৈতিক সামর্থ্য-সক্ষমতার প্রতীক এই অবকাঠামোকে উপমহাদেশের গেম চেঞ্জার বলছেন বিদেশী কূটনীতিকেরা। দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প সম্পন্ন করার সাহসের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। ঢাকায় চীনা দূতাবাসে কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আরও বলেন, বিদেশী কিছু উন্নয়ন অংশীদার বিশ্বাসই করতে পারেনি যে বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এ ধরনের একটি বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে। বৈদেশিক তহবিল বন্ধ সত্ত্বেও দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) অসীম সাহস দেখিয়েছেন। সত্যিই আমার সন্দেহ হয়, এ ধরনের কঠিন সিদ্ধান্ত অন্যদের পক্ষে নেয়া সম্ভব হতো কি না। লি জিমিং বলেন, সেতু সম্পর্কে ভাবতে গেলেই তিনটি শব্দ আমার মনে ভেসে ওঠে। তা হলো সাহস, সঙ্কল্প এবং সমৃদ্ধি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি স্বপ্ন থেকে সেতুটি আজ দৃঢ় বাস্তবে রূপ নিয়েছে এবং এখন থেকে কেউ সন্দেহ করতে পারবে না যে বাংলাদেশ পারে না। আর পদ্মা সেতুকে ঘিরে বাংলাদেশের ওপর আস্থা আরও বেড়েছে চীনের।
পদ্মা সেতু বিশ্বে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। এ প্রকল্প থেকে জাইকার সরে দাঁড়ানো দুঃখজনক ঘটনা ছিল বলে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানান ঢাকায় নিযুক্ত জাপানী রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। তিনি বলেছেন, তার দেশ বিশ্বাস করে এই সেতু শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা উপমহাদেশেরই পট পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে। ইতো নাওকি আরও বলেন, প্রকল্পের শুরুর দিকে সম্ভাব্যতা যাচাই করেও পরে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে দাঁড়ায় জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা। তবে জাপান ও তার জনগণ সব সময়ই এ সেতুর সাফল্য কামনা করেছে। তাই এদেশের নানা উন্নয়ন প্রকল্পের অংশীদার হয়ে সব সময় পাশে থেকেছে জাপান। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, এ সেতু শুধু এদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন করবে না প্রবৃদ্ধিও বাড়াবে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে এই উপমহাদেশে গেম চেঞ্জার হবে পদ্মা সেতু।
চীন ছাড়াও, এ সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল ব্যবস্থাপনার কাজ করবে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান। দেশটির রাষ্ট্রদূত ল জ্যাং কিউন সম্প্রতি গণমাধ্যমে সাক্ষাতকারে বলেছেন, এই অবকাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পেরে আনন্দিত তার দেশ। ল জ্যাং কিউন আরও বলেন, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক এই প্রকল্পে অংশীদার হতে পেরে কোরিয়া আনন্দিত। স্বপ্নের এই সেতুর যাত্রা শুরুতে বাংলাদেশের জণগণকে জানাই অভিনন্দন। এটি শুধু এদেশের মাইলফলক নয়, জনসাধারণের মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত এসা ইউসেফ আলদুহাইলান কয়েকটি গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই সঠিক পথে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। শুক্রবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ। ইসলামাবাদ বলছে, বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় এই সেতুটির উদ্বোধন একটি দৃষ্টান্ত।