ডেস্ক নিউজ
৫৮টি বিধান রেখে চূড়ান্ত হয়েছে নতুন শিক্ষা আইন-২০২০’র খসড়া। ইতোমধ্যে তা অনুমোদনের জন্য গিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। যাচাই-বাছাই শেষে শীঘ্রই মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে আইনটি তোলা হবে। অনুমোদনের পরই উঠবে জাতীয় সংসদে। এতে প্রায় ১২ বছরের জল্পনা-কল্পনার অবসান হতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১০ সালের শিক্ষানীতির সঙ্গে সমন্বয় করেই প্রণীত হতে যাচ্ছে নতুন শিক্ষা আইন। যেখানে থাকছে চার স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা। শুধু তাই নয়, থাকছে বাণিজ্যিক কোচিংয়েরও সুবিধা। নতুন শিক্ষা কারিকুলামে পরীক্ষাকে এত গুরুত্ব না দিলেও চূড়ান্ত করা খসড়া আইনে শিক্ষার্থী মূল্যায়নে রাখা হয়েছে পরীক্ষা ব্যবস্থাও। তবে নতুন শিক্ষা আইনের খসড়ায় সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তির ওপর বিধিনিষেধ জারি করা হচ্ছে। যুক্ত করা হয়েছে শিক্ষক সুরক্ষার বিধানও।
নতুন এ খসড়া আইনে প্রাথমিক শিক্ষাকে সম্পূর্ণ অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। এতে করে দেশের একটি শিশুও নিরক্ষর থাকবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে নতুন আইন প্রণীত হলে, পূর্বানুমতি ছাড়া কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না। এমনকি বাংলাদেশী কারিকুলামে অনুমতি ছাড়া বিদেশেও কোন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রস্তাবিত আইনে চার স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছেÑ পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক, দশম শ্রেণী পর্যন্ত মাধ্যমিক এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী উচ্চ মাধ্যমিক স্তর। এর পর শুরু উচ্চশিক্ষা স্তর। এছাড়া প্রাক-প্রাথমিক স্তরের কথাও আছে আইনে। ২০১০ সালে সংসদে পাস করা শিক্ষানীতিতে প্রাক-প্রাথমিক বাদে তিন স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা আছে। তবে আইনের অন্য ধারার নির্দেশনা অনুযায়ী এটি সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
খসড়া আইন অনুযায়ী, নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না শিক্ষকরা। তবে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জনকে কোচিং করানো যাবে। এতে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারকে বৈধতা দিয়ে বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে পাঠদানের উদ্দেশ্যে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা বা কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করা এ আইনের অধীন নিষিদ্ধ হবে না। এক্ষেত্রে দুটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এগুলো হলোÑ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলাকালীন সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা যাবে না। করা হলে ওই কোচিং সেন্টারের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা যাবে। আর কোচিং সেন্টারে কোন শিক্ষক তার নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করতে পারবেন না। করলে তা অসদাচরণ হিসেবে শাস্তিযোগ্য হবে। এছাড়া, প্রাইভেট টিউশন সম্পর্কে বলা হয়, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক অর্থের বিনিময়ে মূল শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে যে কোন স্থানে শিক্ষা প্রদান করতে পারবে।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষকদের কোচিং বা প্রাইভেট একেবারে বন্ধ করে দেয়া হবে না। ক্লাসে কিছু শিক্ষার্থী দুর্বল থাকে তাদের বাড়তি চর্চা করতে হয়। যাদের প্রয়োজন হবে তারা এসব স্থানে যাবে। তাতে কোন বাধা থাকবে না। তিনি বলেন, সব শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের পক্ষেও পড়াশোনার বিষয়ে সন্তানকে প্রয়োজনীয় সময় দেয়া সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে তারা কোচিং-প্রাইভেটে পড়তেই পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, অনেক শিক্ষক ক্লাসে ঠিকমতো না পড়িয়ে তাদের কাছে শিক্ষার্থীদের পড়তে বাধ্য করেন, সেটি অনৈতিক। এটিকেই আমরা বন্ধ করতে চাই। এটি মনিটরিংয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কোন মনিটরিং টিম থাকবে কিনা জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আসলে এত পরিমাণ জনবল আমাদের নেই। স্থানীয় পর্যায়েই এটি মনিটরিং হবে।
তবে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের নোটবই, গাইডবই ক্রয় বা পাঠে বাধ্য করেন তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, ব্যবস্থাপনা কমিটি বা পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাবে। তবে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে সহায়ক বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ ও বাজারজাত করা যাবে।
আইনে ইংরেজী মাধ্যমের বা বিদেশী পাঠক্রমের শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সাধারণ ধারার সমপর্যায়ের বাংলা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাংলাদেশ স্টাডিজ এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে পড়াতে হবে। এর ব্যত্যয় করলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। এছাড়া, বিদেশী পাঠক্রমে পরিচালিত স্কুল, কিন্ডারগার্টেন ও মাদ্রাসা অথবা বিদেশী কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে শাখা স্থাপন বা পরিচালনার জন্য নিবন্ধন করতে হবে। বিদেশী পাঠক্রম অনুযায়ী পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন, টিউশন ও অন্যান্য ফি আইন, বিধি বা আদেশ দ্বারা নির্ধারিত হবে।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া কোন বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না। যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিবন্ধন ছাড়া পরিচালনা করা যাবে না প্রতিষ্ঠান। এমনকি বাংলাদেশী কারিকুলামে বিদেশে প্রতিষ্ঠান স্থাপনেও অনুমতি লাগবে। ট্রাস্ট বা সংস্থা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারবে অনুমতি সাপেক্ষে। কিন্তু এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের আয়ের অর্থ অন্যত্র সরানো যাবে না। কোন এলাকায় প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন না থাকলে সরকার তা পার্শ্ববর্তী অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত, স্থানান্তর বা বিলুপ্ত করতে পারবে।
খসড়ায় উচ্চ শিক্ষা স্তরের প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে শুধু সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় চিহ্নিত হয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাটি স্পষ্ট উল্লেখ নেই। এ অংশে বলা হয়েছে, সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফি সরকার বা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতিতে হবে। নির্ধারিত বিষয়ের আলোকে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ করতে হবে। আইনে শিক্ষার্থীর ক্লাসে উপস্থিতির ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ক্লাসে উপস্থিতি ৬০ শতাংশের কম থাকলে উপযুক্ত কারণ প্রদর্শন ছাড়া পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না শিক্ষার্থীরা। ক্লাসে উপস্থিতি ৪০ শতাংশের কম থাকলে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না।
পরীক্ষায় নকলে সহায়তা করা এবং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও এতে সংশ্লিষ্টতা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের জন্য ২ বছর কারাদণ্ড অথবা দুই লাখ টাকা দণ্ড অথবা উভয়দণ্ড দেয়া যাবে। কোন শিক্ষক নৈতিকতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়ালে তার শিক্ষক নিবন্ধন বাতিল করা যাবে।
এতে নয়টি কারণে বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও আংশিক বা সম্পূর্ণ সাময়িকভাবে বন্ধ ও কর্তন এবং বাতিলের কথা বলা হয়েছে। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান কার্যপরিধির বাইরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এবং এ কারণে কোন অনিয়ম বা পাঠদান বাধাগ্রস্ত হলে কমিটি সার্বিকভাবে বা ক্ষেত্রমতে চেয়ারম্যান দায়ী হবেন। এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ ওই কমিটি বাতিল বা ক্ষেত্রমতে চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে পারবে।