শেখর কুমার স্যান্নাল:
প্রিয়বন্ধু বিশ্বনাথ সরকার
প্রিয়বন্ধু বিশ্বনাথ সরকার প্রয়াত হওয়ার পর একটি বছর চলে গেল।
বিশ্বনাথ ছিল নাটোরের একজন খ্যাতনামা গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষক। সে না ছিল আমার সহপাঠী, না ছিল আমার সহকর্মী। প্রায় সমবয়সী বিশ্বনাথ যখন গ্রামের স্কুল ছেড়ে নাটোর মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয় তখন আমি একই স্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্র। বিশ্বনাথ মেধাবী ছাত্র ছিল, তার প্রমাণ সে রেখেছিল স্কুলে প্রথম পরীক্ষা থেকেই। ওদের ক্লাসে প্রায় একই মানের কয়েকজন মেধাবী ছাত্র ছিল- নজরুল ইসলাম, বিশ্বনাথ সরকার, নীরেন ঠাকুর, কালিদাস ভট্টাচার্য, সুকুমার পাল ও বীরেশ্বর ঘোষ। এক পরীক্ষায় একজন প্রথম হয় তো পরের পরীক্ষায় আর একজন। নীরেন ঠাকুর ও সুকুমার পাল নবম শ্রেণিতে উঠে ভারতে চলে যায়।
১৯৫৮ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশান পাস করে আমি ভর্তি হলাম নাটোর কলেজে (তখন এই নামই ছিল) বাণিজ্য বিভাগে। ১৯৫৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশান পাস করে বিশ্বনাথ ভর্তি হলো পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে। সহপাঠী বন্ধু শ্যামল ভৌমিকের সাথে একবার পাবনায় গিয়ে কলেজের হিন্দু হস্টেলে ওর আতিথ্যে দু’দিন কাটিয়ে শীতলাই হাউস, সৎসঙ্গ আশ্রম ও মানসিক হাসপাতাল দেখে এসেছিলাম, স্মৃতিতে আজও তা অম্লান।
আই.এসসি. শেষ করে বিশ্বনাথ অভিভাবকদের চাপে নৈহাটিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয়েছিল। বিষয়টি তার পছন্দ ছিল না, তারপর সে ছিল অনেকটা গৃহপ্রাণ। ১৯৬২ সালে গ্রীষ্মের ছুটিতে কলকাতা গিয়েছিলাম দিদিদের দেখতে। তখন শেয়ালদাহ থেকে সরাসরি ট্রেনে নাটোরে আসা যেত। কলকাতা থেকে ফেরার দিন বিশ্বনাথ নৈহাটি স্টেশানে এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। ট্রেনে উঠে কথা বলতে বলতে রানাঘাট পর্যন্ত এল, পারলে যেন আমার সাথে নাটোরেই চলে আসে। কিছুদিন পর পাঠ অসমাপ্ত রেখে বিশ্বনাথ দেশে ফিরে এডওয়ার্ড কলেজে বি.এসসি.তে ভর্তি হলো।
আমি অধ্যাপনা শুরু করি ১৯৬৪ সালে এম.কম. পরীক্ষা শেষে নাটোর নবাব সিরাজ-উদ দৌলা কলেজে। প্রায় একই সাথে বি.এসসি. করে বিশ্বনাথ শিক্ষকতা শুরু করে নওগাঁ করোনেশান হাই স্কুলে। কিছুদিন পরে চলে আসে নাটোর জিন্নাহ্ মেমোরিয়াল হাই স্কুলে (বর্তমান নাটোর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে)। আমি অবসরে গিয়েছি পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানের প্রফেসর হিসেবে ১৯৯৯ সালে, বিশ্বনাথ অবসরে যায় ২০০০ সালে সিরাজগঞ্জের জেলা শিক্ষা আধিকারিক হিসেবে। প্রায় সব ক্ষেত্রে আমাদের ভিন্নতা। অথচ আমার সাথে বিশ্বনাথের গড়ে উঠেছিল অসাধারণ অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের, বলতে গেলে প্রায় আত্মীয়ের সম্পর্ক।
“দদাতি প্রতিগৃহ্নাতি গুহ্যমাখ্যাতি পৃক্ষতি।
ভুঙতে ভোজয়তে চৈব ষড়বিধি প্রীতিলক্ষণং।।
দান করা, প্রতিদান গ্রহণ করা, গোপন কথা বলা, গোপন কথা শোনা, ভোজন করা, ভোজন করানো – শাস্ত্রবাক্য অনুসারে এই ছ’টি দু’জন মানুষের মধ্যে প্রীতির লক্ষণ। সে অর্থেও আমি ও বিশ্বনাথ ছিলাম পরস্পরের পরম সুহৃদ। একমাত্র ঘনিষ্ট বন্ধু যে আমাকে নাম ধরে না ডেকে ‘বন্ধু’ নামেই সম্বোধন করত। অবসর জীবনে বৈকালিক হাঁটায় সে ছিল আমার নিত্য সঙ্গী।
বিশ্বনাথের পৈত্রিক বাড়ি সিংড়া উপজেলায় লালোর ইউনিয়নের বড় বারৈহাটি গ্রামে। ওরা ছিল বেশ সঙ্গতিপূর্ণ জোতদার। ওর বাবা শ্রীকালিনাথ সরকার ডাঙ্গাপাড়া স্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন। আমার শ্বশুর শ্রীবিজয়কৃষ্ণ সিংহের জমিদার বাড়ি ছিল সেই গ্রামে। বিশ্বনাথ এবং আমার স্ত্রী সেবা একই বছর ম্যাট্রিকুলেশান পাস করে, সেবার সহকর্মীও ছিল অনেক বছর নাটোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। তাই তার সাথে আমার হৃদ্যতা শুধু ব্যক্তিগত নয়, পারিবারিকও বটে। আমার ছেলেমেয়েরা বিশ্বনাথকে ‘মামা’ বলে ডাকত। আমার স্ত্রীর নিজের ভাইয়েরা সবাই ভারতে। নাটোর লালবাজারে বিশ্বনাথের বাড়িই ছিল জয়দীপ-সুমন-জয়ীতা-সুদীপের মামাবাড়ি। বিশ্বনাথের স্ত্রী আমার ভগ্নীতুল্য ললিতা স্কুলে সেবার এবং কলেজে আমার ছাত্রী ছিল। বিশ্বনাথের ছেলেমেয়ে সৈকত-মুনমুন-শ্রাবণী-দিবাকর আমাকে নিজের জেঠু বলেই মনে করে। আমার সব ছেলেমেয়েই বিশ্বনাথের কাছে গণিত এবং বিজ্ঞানের পাঠ নিয়েছে। কর্মজীবনে অসংখ্য কৃতী ছাত্রছাত্রীর শিক্ষক ছিল বিশ্বনাথ। তাদের অনেকেই কর্মজীবনে কীর্তিমান হয়েছে। ওর ছেলেমেয়ের মধ্যে কেবলমাত্র মুনমুন আমার সরাসরি ছাত্রী হলেও ওরা সব ভাইবোন আমাকে তাদের প্রেরণার উৎস বলে মনে করে।
আমার শ্বশুর সেবাকে তাঁর জমিদার বাড়ি এবং কিছু ভূসম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিলেন। সেগুলো দেখাশোনা করতে বিশ্বনাথের সাথে মাঝে মধ্যে ওদের গ্রামের বাড়িতে যেতাম বাইসাইকেলে। বিশ্বনাথের সৌম্যদর্শন মা ছিলেন অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। আমাকে দেখেই মধুর হেসে বলতেন, ‘অতিথি নারায়ণ’। মা’র সেই গুণ বিশ্বনাথ পেয়েছিল অপর্যাপ্ত ভাবে। সে ছিল অসাধারণ উদারচিত্ত মানুষ। আমার বাসায় কোন অতিথি এলে বিশ্বনাথ তার বাসায় অন্তত একবেলা খেতে বলবে না, এমনটি কখনো ঘটে নি। এরকম একবার দু’বার নয়, বহুবারই হয়েছে।
১৯৮৩ থেকে প্রায় সাড়ে চার বছর আমি পদোন্নতি জনিত বদলিতে গাইবান্ধা সরকারি কলেজে ছিলাম। ১৯৮৭ সালে নাটোর নবাব সিরাজ-উদ দৌলা কলেজে বদলির আদেশ এলে বিশ্বনাথ গাইবান্ধা চলে গিয়েছিল আমাকে আনতে। আমার প্রতি এতটাই টান ছিল তার।
উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে।
রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্টতি স বান্ধবঃ।।
সুখে, দুঃখে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে সাথে থাকে সেই প্রকৃত বন্ধু। পরস্পরের সুখ-দুঃখ আমরা সব সময় ভাগ করে নিয়েছি। একাত্তরের রাষ্ট্রবিপ্লবের সময় আমি সপরিবার প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিলাম বিশ্বনাথের গ্রামের বাড়িতে, যদিও কয়েকদিন পরেই উঠে যাই শ্বশুরের জমিদার বাড়িতে। আমার শরণার্থী জীবনের স্মৃতিকথা ‘একাত্তরে পথে প্রান্তরে’ বইতে গ্রন্থিত আছে সে কাহিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিশ্বনাথ এবং আমি দু’জনেই পরিবার-পরিজন সহ উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেম ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। মাঝে মাঝে আমি নৈহাটিতে বিশ্বনাথকে দেখতে গিয়ে রাত্রিবাসও করেছি ওদের বাসায়।
২০১৫ সালের ২০ জুন ঢাকায় কন্যা জয়ীতার বাসায় আমার কনিষ্ঠ পুত্র সুদীপের আকস্মিক মৃত্যুর দুঃসংবাদ পেয়ে বিশ্বনাথ-ললিতা ছুটে এসেছিল সান্ত্বনা দিতে, আমাদের দুর্বিসহ শোক প্রশমিত করতে।
শেষ জীবনে কিডনি ডায়ালেসিস করে তার কষ্টকর দিন কাটছিল। ২০২১ সালের ৯ আগস্ট যখন বিশ্বনাথ প্রয়াত হয় তখন চিকিৎসাধীন গুরুতর অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে আমি ঢাকায় কন্যার বাসায়। গভীর পরিতাপের বিষয়, বিশ্বনাথের শেষ যাত্রায় তার অনুগামী হতে পারি নি।
বিশ্বনাথের সাথে রয়েছে আমার অসংখ্য স্মৃতি যা লিখে শেষ করা সম্ভব নয়।
চিরআনন্দময় অমৃতলোকে থেকো বন্ধু!
অসতো মা সদ্গময়,
তমসো মা জ্যোতির্গময়,
মৃত্যোর্মামৃতং গময়।
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ-১/৪/২৮)
অসৎ হতে আমাকে সত্যস্বরূপে নিয়ে যাও, অন্ধকার হতে আমাকে আলোকে নিয়ে যাও, মৃত্যু হতে আমাকে অমৃতে নিয়ে যাও।