ডেস্ক নিউজ
লোড শেডিংয়ে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চট্টগ্রামের শিল্প মালিকরা যখন চোখে অন্ধকার দেখছেন, এ সময় একটি প্রতিষ্ঠান নিজের উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে তাদের কারখানা সচল রাখছে।
চট্টগ্রামের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) ইউনিভার্সাল জিন্স নামের কারখানাটি এভাবে লোড শেডিংয়ের বিড়ম্বনা কাটাতে সফল হয়েছে।
সৌর প্যানেল দিয়ে উৎপাদিত সৌরশক্তি ব্যবহার করে প্রতিদিন সাড়ে তিন মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে তারা। কারখানার চাহিদার একটি বড় অংশ মেটাচ্ছে এই প্রাকৃতিক উৎস।
এ জন্য কারখানাটির ছাদের ৪৯ হাজার বর্গফুটজুড়ে বসানো হয়েছে এক হাজার ২৯৯টি সৌর প্যানেল। আগামী তিন বছরের মধ্যে এই গোষ্ঠীর বাকি ৯টি কারখানার ছাদও ঢেকে দেওয়া হবে সৌর প্যানেলে। এতে প্রতিদিন প্রায় ৩৩ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দেশের জিন্স খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ। তাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সাল জিন্স দেশের রপ্তানিশিল্পে সুনাম কুড়িয়েছে। রপ্তানি খাতে অবদান রাখার জন্য টানা আট বছর ধরে জাতীয় রপ্তানিতে স্বর্ণ পদক পেয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ অর্থবছরেও এককভাবে এই একটি কারখানা থেকে ১৯৮ মিলিয়ন ডলার বা এক হাজার ৮৮১ কোটি টাকার তৈরি পোশাক রপ্তানি করা হয়েছে বিদেশে।
সেই কারখানায় দেশের ইপিজেডগুলোর মধ্যে সর্ব প্রথম এমন বৃহৎ পরিসরে সৌর প্যানেল বসিয়েছে প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ। গত এপ্রিল থেকে পরীক্ষামূলক উৎপাদন করলেও গতকাল থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছে। উৎপাদিত সাড়ে তিন মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিয়ে মেটানো যাবে চাহিদার ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ। পুরো প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ডলার বা পৌনে পাঁচ কোটি টাকা। সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের ফলে বছরে প্রায় কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে প্রকল্প ব্যয় উঠে আসবে।
এ ব্যাপারে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (হেড অব সাস্টেইনেবিলিটি অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স) আনোয়ারুল ইসলাম হিসাব করে দেখান, ‘বর্তমানে বেপজা থেকে আমরা প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ কিনি ৯.৪১ টাকা করে। আমাদের সৌর প্যানেল থেকে দৈনিক সাড়ে তিন মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যদি বছরের ৩০০ দিন ব্যবহার করা হয় সেক্ষেত্রে বছরে এক হাজার ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে প্রাকৃতিক উৎস থেকে। প্রতি মেগাওয়াটের বিল ৯ হাজার ৪১০ টাকা হিসেবে বছরে ৯৮ লাখ ৮০ হাজার টাকার বিল সাশ্রয় হবে সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে। এভাবে মাত্র পাঁচ বছরেই পুরো খরচ উঠে আসবে। যদিও প্যানেলের গ্যারান্টি ২০ বছর। ’
ইউনিভার্সাল জিন্সে বসানো সৌর প্যানেলের বিশেষত্ব হলো, জার্মানির তৈরি যে ইনভার্টার ব্যবহার করা হয়েছে, এতে সিস্টেমটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রথমে সৌর উৎপাদিত শক্তি ব্যবহার করবে। তারপর কারখানার অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে অন্যান্য উৎস থেকে কেনা বিদ্যুৎ কারখানার উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা হবে। প্যানেল পরিষ্কার রাখতে স্প্রিংলার সিস্টেম ব্যবহার করার কারণে রক্ষণাবেক্ষণ খরচও নেই বললেই চলে।
প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘমেয়াদি টেকসই লক্ষ্যমাত্রার একটি অংশ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প। লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের ব্যবহৃত মোট বিদ্যুতের ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পাওয়া। এতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমে আসবে ৬৫ শতাংশে। ’
তিনি বলেন, ‘ক্রেতারা এখন পরিবেশবান্ধব উৎপাদনকে উৎসাহিত করছে। ভবিষ্যতে এই শিল্পে টিকে থাকতে হলে পুরো উৎপাদনপ্রক্রিয়া পরিবেশবান্ধব হতে হবে। আমরা সেই পথেই আছি। ’
আগামী মাসে গ্রুপের আরেকটি প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্সে চালু হচ্ছে দৈনিক সাড়ে পাঁচ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার সৌরবিদ্যুতের আরেকটি প্রকল্প। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির ৮০ হাজার বর্গফুটের ছাদে বসানো হয়েছে এক হাজার ৯২৮টি প্যানেল। ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ডলার। উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে কারখানাটির দৈনিক চাহিদার ১৫ শতাংশ মেটানো যাবে এবং বছরে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস হবে এক হাজার ৪৭ টন।
প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ সূত্র জানায়, এভাবে একে একে গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের ছাদ সোলার প্যানেল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে। এভাবে ২০২৫ সালের মধ্যে গ্রুপের ১০টি কারখানায় স্থাপিত সোলার প্যানেল থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩২.৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, যা দিয়ে গ্রুপটির মোট চাহিদার ২০ শতাংশ মেটানো হবে।
যদিও এর শুরুটা হয়েছিল ২০১৭ সালে প্যাসিফিক জিন্সের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এনএইচটি ফ্যাশন লিমিটেড ৩৫০ কিলোওয়াটের একটি পাইলট প্রকল্প দিয়ে। গত পাঁচ বছরে এই প্রকল্প থেকে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে এবং কার্বন নিঃসরণ কমেছে ৬০০ টন।
লোড শেডিংয়ে দিশাহারা শিল্পমালিকদের সঙ্গে গত রবিবার বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে দেশের শিল্প এলাকাগুলোতে সপ্তাহের ভিন্ন ভিন্ন দিন ছুটি দেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছে। ঠিক এমন সময় নিজস্ব উদ্যোগে সৌর প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসাকে সময়োপযোগী পদক্ষেপ বলে মনে করছেন শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবুল কালাম মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান বলেন, ‘এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। প্রধানমন্ত্রী নিজেই নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর জোর দিচ্ছেন। সেখানে প্যাসিফিক জিন্সের এমন উদ্যোগ অন্যদেরও সাহস জোগাবে। ’
মিরসরাইয়ের বেপজা ইকোনমিক জোনে মোট ব্যবহারের ৫ থেকে ১০ শতাংশ বিদ্যুতের জন্য সৌর প্যানেল বসানো হবে বলে তিনি জানান।