ডেস্ক নিউজ
সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং ওই ঘটনার দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবহিত করলো আওয়ামী লীগ। দলটির নেতৃবৃন্দ ও সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্যরা ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন মিশনের কর্মকর্তাদের কাছে ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন। তারা বঙ্গবন্ধুর বিদেশে পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার কথা বলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের সহযোগিতা কামনা করেন। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুহত্যার নেপথ্যে জড়িতেদের মুখোশ উন্মোচন ও ইতিহাসের সঠিক তথ্য জাতির সামনে তুলে ধরতে কমিশন গঠনের কথাও বলেন।
শনিবার (২০ আগস্ট) ঐতিহাসিক ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে দলের আন্তর্জাতিক উপকমিটি আয়োজিত জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ‘অ্যানালস অব হিস্ট্রি: দ্য ইনডেলিবল মার্ক অব আগস্ট’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা অংশগ্রহণ করেন। পরে কূটনীতিকরা জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ও বঙ্গবন্ধু জাদুঘর ঘুরে দেখেন।অনুষ্ঠানে উপস্থিত কূটনীতিকদের একাংশ
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান অ্যাম্বাসেডর এম জমিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ, জাতীয় সংসদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য নাহিদ এজহার খান, বঙ্গবন্ধুহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলার বাদী আব্দুর রহমান শেখ রমা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আনিসুল হক তার বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে দীর্ঘ ২১ বছর বিচার বন্ধ রাখাসহ বিচারপ্রক্রিয়া তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির পর বিচার তো দূরের কথা মামলা পর্যন্ত করার সুযোগ ছিল না। কোনও অসভ্য দেশেও এ ধরনের আইন থাকতে পারে না।
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বিচারের পথ উন্মুক্ত করে উল্লেখ করে এই আইনজীবী বলেন, সরকার চাইলে সামারি ট্রায়ালের মাধ্যমে ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে পারতেন। সেটা হলে ৩/৪ মাসের মধ্যে বিচার শেষ করা সম্ভব হতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সেটা চাননি। অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতো ওই বিচারও সাধারণ আইনি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি জানান, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ওই বিচার আবারও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ সময় সাতজন বিচারপতি বিচার করতে বিব্রতবোধ করেছেন। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আবারও বিচার কাজ শুরু হয় এবং ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর উচ্চ আদালতে, আপিল, রিভিউ সব প্রক্রিয়া শেষ করার পর বিচারের রায় সম্পন্ন করা হয়।
তিনি জানান, কোনও ক্ষোভ বা প্রতিহিংসায় বশীভূত হয়ে সরকার বিচার করেনি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচারের জন্যই এটা করেছে।
বিচার প্রক্রিয়ায় বাঁধা দিতে জিয়াউর রহমান ও পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আইনমন্ত্রী। এ সময় বিদেশি দূতদের উদ্দেশ্য করে মন্ত্রী বলেন, এখানে দোষারোপের রাজনীতি করতে আসিনি। আমরা সত্য তুলে ধরতে এসেছি। আপনাদেরও সুযোগ হবে এটা যাচাই করার।
বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের সরকার খুঁজছে উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, আমরা বিদেশে পলাতক বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য খুনিদের দেশে ফিরিয়ে বিচারের রায় বাস্তবায়ন করতে চাই। সরকার এ লক্ষ্যে কাজ করছে। আমরা এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চাই। যেসব দেশে খুনিরা পালিয়ে রয়েছে তাদেরকে অনুরোধ করি তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হোক। প্রতিশোধ নয়, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য আমরা এটা চাই। আমরা সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিতে চাই বাংলাদেশ কোনও হত্যাকারীকে প্রশ্রয় দেয় না।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার নেপথ্যে জড়িতদের খুঁজে বের করতে কমিশন গঠনের কথা উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, আমরা বিচারকার্য সম্পন্ন করেছি। এখন পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে চাই। কারা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল, কারা তাদের মদত দিয়েছে— এটা জাতি জানতে চায়। আমাদের জাতির জন্যও এই সত্য ঘটনা জানা দরকার। এজন্য আমরা কমিশন গঠন করতে চাই। এই কমিশন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য গঠন করা হবে না। ইতিহাসকে ইতিহাসের সঠিক জায়গায় স্থান করে দেওয়ার জন্য এটা গঠন করা হবে। যাতে মানুষ জানতে পারে প্রকৃতপক্ষে ওই সময় কী ঘটেছিল।
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেছে। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে জিয়াউর রহমান আইনি বৈধতা দিয়ে বঙ্গবন্ধুহত্যার বিচার বন্ধ করে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে। যে কারণে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা পিতাসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার চাইতে পারেননি।জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন কূটনীতিকরা
কূটনীতিকদের উদ্দেশ্য করে মন্ত্রী বলেন, আপনাদের কাছে বিএনপি নেতৃবৃন্দ যান। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন। আপনাদের প্রতি অনুরোধ করবো আপনাদের কাছে বিএনপি গেলে জিয়াউর রহমান কেন ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স পাস করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার থেকে রেহাই দিয়েছিল— সেই প্রশ্নটি করবেন। আজকে বিএনপি নিরীহ মানুষদের পেট্রোল বোমা মেরে মারছে, শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে— এটা কী মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়? এই প্রশ্নও বিএনপিকে করবেন এই অনুরোধ করছি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর কিছু খুনি এখনও বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। আশা করবো যেসব দেশে পালিয়ে রয়েছে সেই দেশের সরকার আইনের শাসনের বিষয়টি উপলব্ধি করে ওইসব খুনিদের ফিরিয়ে দেবেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানের সভাপতি এম জমির তার বক্তব্যে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে মাদক পাচারসহ শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করছে।