ডেস্ক নিউজ
রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে কেউ যাতে রাজপথে নেমে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, রাস্তা বন্ধ করে সভা-সমাবেশ, যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা কিংবা অগ্নিসংযোগসহ কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে দেশজুড়ে গোয়েন্দা তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
অবশ্য বিষয়টি নিয়ে পুলিশের কোনো পর্যায় থেকেই আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। নাম প্রকাশ করে কোনো কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাননি। তবে ডিএমপির জ্যেষ্ঠ দু’জন কর্মকর্তা বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও লোডশেডিংসহ বিভিন্ন ইসু্যতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথে আন্দোলনের নামে তান্ডব চালাতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করা হচ্ছে। যার কিছু আলামত এরই মধ্যে পাওয়া গেছে। তাই ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া কেউ যাতে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে, সে জন্য পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে।
প্রশাসনিক সূত্রগুলো জানায়, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ১৫/১৬ মাস বাকি থাকলেও তাতে অংশগ্রহণের না করার সিদ্ধান্তে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এখনও অটল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে তারা তাতে অংশ নেবে না বলে সাফ জানান দিয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারকে বাধ্য করতে সরকারবিরোধী এ দলটি স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়ানোর চেষ্টা করবে। ঘোষণা হতে পারে সরকারবিরোধী এক দফার কর্মসূচি। অলআউট কর্মসূচি ঘোষণা করে দলের নেতাকর্মীরা রাজপথে নেমে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে তাদের মোকাবিলা করতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ মাঠে নামার আগাম ঘোষণা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলো সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ারও জোরালো আশঙ্কা রয়েছে। তাই দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই সরকার আগেভাগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে রাখার প্রস্তুতি নিয়েছে।
সরকারের এ ‘স্ট্যাটিজিক পস্ন্যানে’ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অহেতুক হয়রানি-নির্যাতনের কোনো ছক নেই বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতনরা দাবি করেন। তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, সাম্প্রদায়িক শান্তি বিনষ্টে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র বানচাল, রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে সৃষ্ট নৈরাজ্য ঠেকিয়ে নির্বাচনী লেভেল পেস্নয়িং ফিল্ড তৈরির লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই অ্যাকশন পস্ন্যানের আওতায় রাজপথে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অস্ত্রধারী পলিটিক্যাল ক্যাডারদের ধরপাকড় করা হবে। বিশেষ করে নানা উসকানিতে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার মিশনে নামা ভয়ংকর ষড়যন্ত্রকারী চক্র এবং এর নেপথ্য মদদদাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ‘অ্যাকশনে’ নামা হবে।
পুলিশের এআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, বিগত সময়ে বিভিন্ন সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় শুধু সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও এখন থেকে এ ব্যাপারে আরও কঠোর হবে পুলিশ। এ ধরনের ঘটনা দ্রম্নত তদন্ত করে এর নেপথ্য মদদদাতা ও হুকুমদাতাকেও আসামি করা হবে। এতে গোপন বৈঠক করে পলিটিক্যাল গডফাদারদের নাশকতা চালানোর অপতৎপরতা কমবে।
এদিকে সরকারের হার্ডলাইনে নামার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কারও কাছ থেকে সরাসরি কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও থানার ওসিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ কর্মপরিকল্পনার নানা কৌশলের কথা জানিয়েছেন। মামলা ও ওয়ারেন্ট মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ানো পলিটিক্যাল ক্যাডারদের গ্রেপ্তারে ওপর মহলের জোরালো তাগিদের বিষয়টিও তারা স্বীকার করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিরপুর জোনের একটি থানার একজন ওসি (তদন্ত) যায়যায়দিনকে জানান, বিএনপি-জামায়াত ও শিবিরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সক্রিয় নেতাকর্মীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এরই মধ্যে তারা জোগাড় করেছেন। এদের কার বিরুদ্ধে কতটি মামলা রয়েছে, কোনো মামলায় আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে কি না এবং কে কোথায় অবস্থান করছেন- সে তথ্যও তাদের হাতে রয়েছে। ক্যাটাগরিওয়াইজ নেতাদের তিন ভাগে ভাগ করে সে তালিকা প্রতিটি থানার সাব-ইন্সপেক্টরদের মধ্যে বণ্টন করে তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের কোনো সক্রিয় নেতা ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী কারও ঘাড়ে ভর করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কি না তা খুঁজে বের করারও নির্দেশনা রয়েছে। বিগত সময়ে বোমাবাজি, নাশকতা ও সহিংসতার সঙ্গে জড়িত কোনো ক্যাডারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতা ছাড়িয়ে নেওয়ার তদবির করলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এ মিশন সফল করতে থানা পুলিশের সঙ্গে স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) ও ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টসহ (সিআইডি) সার্বিক কার্যক্রম সমন্বয় করবে। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে রিজার্ভ ফোর্সের সহায়তাও নেওয়া হবে। এ প্রস্তুতি চূড়ান্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এরই মধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ডিএমপির একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতার সঙ্গেই বিরোধী শিবিরের গোপন আঁতাত রয়েছে। এদের কেউ কেউ গোপন ও প্রকাশ্যে একসঙ্গে একাধিক ব্যবসা চালাচ্ছেন। এমনকি তারা মিলেমিশে টেন্ডারবাজি, ভূমি দখল ও চাঁদাবাজি করছেন। এ তালিকা তৈরির কাজও পুলিশ শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এসব ‘ডুয়েল পেস্নয়ারদেরও’ কঠোর নজরদারিতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সরকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের সতর্ক অবস্থানে থাকার কথা বললেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা তা ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন। তাদের ভাষ্য, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরেই আবর্তিত হবে আগামী কয়েক মাসের রাজনীতি। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পালস্না দিয়ে জোরদার হবে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে সরকার মূলত প্রশাসনকে দিয়ে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করে রাখতে চাইছে।
তাদের ভাষ্য, বিএনপিকে ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানামুখী সমালোচনা রয়েছে। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের বিশেষ নজর থাকবে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের ওপর যত কৌশলেই নির্যাতনের খড়গ নামানো হোক না কেন তাতে সরকারের ইমেজ ক্ষুণ্ন হবে। যার নেতিবাচক প্রভাবে নির্বাচনের মাঠে পড়বে।
কেউ কেউ মনে করছেন, পুলিশের সতর্ক অবস্থানে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা কোণঠাসা না হয়ে বরং প্রচন্ড ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে জ্বালাও-পোড়াও ও ভাঙচুরসহ নানামুখী নৈরাজ্যে জড়িয়ে পড়তে পারে। যা ২০১৪ সালের জানুয়ারির মতো বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞের আরও একটি কালো অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।
বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে পুলিশের সতর্ক অবস্থান প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ জানান, ‘কেউ যাতে সহিংসতা বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে না পারে সেজন্য রুটিন কাজের অংশ হিসেবেই আমরা গোয়েন্দা নজরদারি করে থাকি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেকেই “ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের” চেষ্টা করতে পারে। আমরা সতর্ক রয়েছি।’