ডেস্ক নিউজ
বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটের প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন করে পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এতদিন দেশীয় জ্বালানি অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জোর দেয়ার জন্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বার বার তাগিদ দিলেও তা আমলে নেয়া হয়নি। এখন বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের চাপে পড়ে টনক নড়েছে নীতি-নির্ধারকদের। জ্বালানি খাতে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় খনিজ জ্বালানি উত্তোলনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২০১০ সালের মাস্টারপ্লান বাস্তবায়নের দিকেই ঝুঁকছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি গ্যাসকূপ খননের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে পেট্রোবাংলা।
ভুল নীতি : বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও জ্বালানির অবস্থান জানতে জরিপ, অনুসন্ধান, উত্তোলন, আমদানি এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর ভুল নীতি অনুসরণ করাই বর্তমান সংকটের মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। কখনো গ্যাসের ব্যবহার, কখনো কয়লার ব্যবহার, আবার কখনো আমদানি করা গ্যাসের ওপর ভর করে প্রয়োজন মেটানোর নীতি নেয়া হয়। যখন যে সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে, তারা রাষ্ট্রের এবং জনগণের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় না রেখে নিজেদের পছন্দের নীতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাস্টারপ্লান নিলেও তা আলো মুখ দেখেনি। ২০১০ সালের মাস্টারপ্ল্যানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫০ ভাগ কয়লা থেকে আহরণের মাস্টারপ্লানও বাস্তবায়ন হয়নি। ফসলি জমি নষ্ট হওয়ার কথা বলে সরকার কয়লা উত্তোলন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতির কারণে আবার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়ে নানান মহল থেকে উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরকারকে আহ্বান জানানো হলেও তা কেউ আমলে নেয়নি। উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানির বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বার বার বিরোধিতা করলেও সংশ্লিষ্টরা তা কানে তোলেননি। এখন উচ্চমূল্যের কারণে এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। সোলার এনার্জির প্রতিও
গুরুত্ব বাস্তবের চেয়ে কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ ছিল। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়া হয়নি- যা এখন দেখা হচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, আজকের এই সংকট সরকারের ভুল নীতির কারণেই সৃষ্টি হয়েছে বলে আমরা মনে করি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগেও দেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছি। আমাদের দেশের তেল-গ্যাস খুঁজে বের করার জন্য জরিপ, অনুসন্ধান এবং উত্তোলনের ওপর জোর দেয়ার আহ্বান জানিয়েছি। সরকারের কর্তাব্যক্তি কান দেননি। অবশেষে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। বিলম্বে হলেও এই উদ্যোগ দরকার ছিল।
উদাসীনতার মাসুল : দেশীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অনীহা ছিল চোখে পড়ার মতো। অনুসন্ধানে অনীহার কারণে পেট্রোবাংলাকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়নি। পেট্রোবাংলায় বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ জনবল নিয়োগ দেয়া হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। খোদ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিজেও প্রকাশ্যে পেট্রোবাংলার কার্যক্রমর বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অথচ আরো ৫/৬ বছর আগে দেশীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু হলে এখন হয়তো কিছুটা হলেও সুফল পাওয়া যেতে। কিন্তু তা না হওয়ায় আজকের সংকট বেড়েছে। সংকটে পড়ে এখন সরকার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে।
তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, বাংলাদেশে অনুসন্ধান হয়নি- এ কথা বলা ঠিক নয়। আমরা দেশের স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করেছি। জ্বালানি সংকটের সমাধানের লক্ষ্যে আমরা দেশীয় জ্বালানির উৎপাদন বাড়াতে গত ৫ বছরে ৩৪টি নতুন-পুরাতন কূপ খনন করেছি। গত বছরই আমরা ৪টি কূপ খনন করেছি। বাপেক্সের সহযোগিতা নিয়ে আমরা অনুসন্ধান কাজে মহাপরিকল্পনা নিয়েছি। বাপেক্স ছাড়া আর কাউকে অনুসন্ধান কাজ করতে দিচ্ছি না। যদিও ভোলায় এই বিধিনিষেধের মধ্যেই গ্যাজপ্রমকে কাজ দেয়া হয়েছে। তবে আমরা আমাদের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আইওসিকে কাজ দিচ্ছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত আশানুরূপ সারা পাচ্ছি না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, সরকারকে স্বল্প মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। মূলত দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েই গ্যাস অনুসন্ধানে যেতে হবে। সরকারের পলিসি হওয়া উচিৎ- নিজস্ব জ্বালানি উত্তোলন ও ব্যবহার করা এবং প্রয়োজন হলে কিছু এলএনজি আমদানি করতে হবে।
অনুসন্ধানের উদ্যোগ : পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান জানিয়েছেন, গ্যাসের অনুসন্ধানে ৪৬টি কূপ খননের মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ভোলার শাহবাজপুরের গ্যাসক্ষেত্রে কাজ শুরু হয়েছে। শ্রীকাইলে একটি রিগ কাজ করছে। এরপর বিয়ানিবাজার ও শরীয়তপুরে খনন কাজ শুরু হবে। রিগ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেও কিছুটা সময় লাগে। পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমরা কাজ করছি। অতীতে যারা পেট্রোবাংলায় দায়িত্বে ছিলেন, তারা তখন কাজ করেননি, অথচ এখন সমালোচনা করছেন।
পেট্রোবাংলার একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে গভীর ও অগভীর সমুদ্রের ২৬টি ব্লকের মধ্যে ৪ ও ৯ নম্বর ব্লকে ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি কাজ করছে। ২০২০ সালে কনকো ফিলিপস, ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, এক্সম মোবিলের মতো কোম্পানির সঙ্গেও পেট্রোবাংলা বৈঠক করেছিল। তখন পিএসসি-২০১৯ এর সংশোধন করা পিএসসি উপস্থাপন করা হয়েছিল। বৈঠক সফল হয়নি। কোম্পানিগুলো এই পিএসসি সংশোধন ও আরো আকর্ষণীয় করার পরামর্শ দেয়। এরপর আর অগ্রসর হয়নি।